আমরা অধিকাংশ সময়ই প্রচন্ড চেষ্টা করি ভুলে যেতে। সেই মানুষটাকে, যে হাজার
হাজার প্রতিশ্রুতি মিথ্যে করে হঠাৎ মাঝরাস্তা থেকে হাত ছাড়িয়ে কর্পূর হয়ে
গ্যাছে। আমরা প্রথম প্রথম কিছুতেই এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারিনা। আকুতি মিনতি
করি, হাতে পায়ে পরি, কান্না কাটি করি। সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে আনতে আমরা নিজেদের
সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। তারপর? 

তারপর আমরা তাদের আজন্মকাল নিজেদের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াই। আর পুরানো স্মৃতি
হাতড়ে, খুঁজতে শুরু করি তাকে, আবার নতুন করে, একা একা।

আরো পড়ুন, অভ্যেস তখন এখন

বুকের ভিতরে আমাদের ভালোবাসার কবরের সামনে রোজ একটা গোলাপ হাতে মাথা নিচু করে
বসে থাকি আমরা। তার উপহার দেওয়া বইয়ের পাতায়, তার হাতের স্পর্শ খুঁজি। একসাথে
সেই বই পড়তে পড়তে যে লাইনগুলোয় থমকে দাঁড়াতাম দুজনেই, সেই লাইনগুলো আবার পড়তে
পড়তে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলি। আমরা সেই সব রাস্তাগুলোয় আবার একলা চলতে শুরু করি,
যেসব রাস্তায় একদিন হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলাম সাত জন্মের। সেই মেসেজগুলো,
সেই শুরুর দিকের চিঠিগুলোর, প্রত্যেকটা শব্দে তার গলার আওয়াজ ভেসে আসে আমাদের
কাছে।

আমরা তাদের খুঁজতে শুরু করি সেই চেনা গানগুলোয় যেগুলো একসময় দুটো মাথাকে এক করে
দিতো একটা হেডফোনের মাধ্যমে। বা গ্র্যান্ডের নিচের সেই বারটায় গিয়ে বসে ঘন্টার
পর ঘন্টা বিয়ার খাই, যে বার আমাদের প্রথম মাতাল হওয়ার স্বাক্ষী ছিলো। কফিহাউসের
সেই টেবিলটায় আবার গিয়ে বসি, যে টেবিলে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যেতো। কফি
ঠান্ডা হয়ে যায়, সিগারেটের প্যাকেট শেষ হয়ে যায়। তারপর বাসের লাস্টের জানলার
ধারের সিটটায় বসে, পুরোটা রাস্তা চোখ বন্ধ করে তার কাঁধে মাথা রেখে বাড়ি ফিরে
আসি। রাতে ঘুমানোর আগে ফোনের গ্যালারি খুলে আমাদের একসাথে ছবিগুলো দেখে ঝরঝর
করে কেঁদে ফেলি। তার ছবিতে অসংখ্য চুমু আঁকতে আঁকতে, কোল বালিশটাকে চিপ্পি করে
জড়িয়ে ধরে বলি ‘ফিরে আয়না প্লিজ!’ 

আমরা চেষ্টা করি, তাকে মনে না করতে। ভুলে যেতে। নিজেকে ডাইভার্ট করি, নিজের
সাথে লড়াই করি, নিজের গালে থাপ্পড় মারি, নিজেকে কষ্ট দিই, নেশা করি। ‘ভুলে যা,
ভুলে যা…’, কিন্তু নাহ! পারিনা। কিছুতেই পারিনা। বরং ভালবাসার মানুষটা চলে
যাওয়ার পর আমরা তাদের ছেড়ে যাওয়া ছোট্ট ছোট্ট জিনিসগুলোকে আরেকটু বেশি করে
আঁকড়ে ধরি। পুরানো সিনেমার টিকিটগুলো, ট্রেনের টিকিটগুলো, রেস্টুরেন্টের
বিলগুলো, তার গায়ের গন্ধে ম্ ম্ করা অমলিন রুমালটা, তার আধ খাওয়া সিগারেটের
অবশেষটুকু, তার হাতেলেখা চিঠিগুলো, ছোট্ট ছোট্ট উপহারগুলো এবং আরো কত কিছু….

আসলে আমরা তাদের কখনোই হাত ছেড়ে যেতে পারিনা, যারা আমাদের হাত ছেড়ে যায়।
তাদেরকে ছাড়াই তাদের সাথে বৃদ্ধ হই আমরা। তাদের বয়ে নিয়ে বেড়াই নিজেদের মধ্যে।
আজন্মকাল। একটা ধাঁধার মতো। যার উত্তর আজও আমাদের কাছে নেই…….