Valobashar Golpo – ভালোবাসার গল্প – Bengali Love Story

Bongconnection Original Published
29 Min Read

 Valobashar Golpo – ভালোবাসার গল্প – Bengali Love Story

Valobashar Golpo - ভালোবাসার গল্প - Bengali Love Story
Loading...

Valobashar Golpo

Loading...

নতুন ভালো বাসায়
ঝুমা ভট্টাচার্য্য
চামচ দিয়ে মুখে বিরিয়ানি তুলতে গিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো তিতির। মাকে এত গম্ভীর দ্যাখাচ্ছে কেন? মা কি কিছু বুঝতে পারলো নাকি? মা আজ তিতিরের প্রিয় খাবার বিরিয়ানি ই বা রাঁধলো কেন?খুব অশান্তি নিয়ে কোনরকমে বিরিয়ানি খাওয়া শেষ করলো তিতির। মা খানিকক্ষণ পরে গজগজ শুরু করলো.. “এই ঘনার মাকে দিয়ে আর চলবে না। ভীষণ কামাই শুরু করেছে আজকাল। “
তাদের ঠিকে কাজের লোক ঘনার মা নাকি কাকে দিয়ে একটু আগে খবর পাঠিয়েছে, সে নাকি কদিন কাজে আসতে পারবে না। দেশের
বাড়িতে যাবে, ঘর সারাতে।
তিতিরের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মা কিছুই বোঝে নি। এবার তিতিরের মন কেমন করতে লাগলো, খুউব। বাড়ির সবার জন্যে তার মন কেমন করতে লাগলো । মা , বাবা, দাদু , ঠাকুমা, দাদা , দিদি , ভাই সব্বার জন্যে।নিজের ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসে রইলো চুপটি করে । খুব কান্না পাচ্ছে তার। দিদির সামনে পরীক্ষা, পড়ার ঘরে বসে পড়ছে, নাহলে তিতির কে দেখলেই বুঝে ফেলতো। কাঁদতে কাঁদতে একবার ব্যাগটা খুলে উঁকি মেরে দেখে নিলো তিতির। ব্যাগে দু একটা শাড়ি ব্লাউজ আর প্রসাধনী। বেশি কিছু নিতে সাহস পায় নি, কিছু জমানো টাকা পয়সা ছিলো। সেগুলো ও একটা পার্সে ভরে সে রেখে দিয়েছে ব্যাগে ।খুব কান্না পেলো তার। কাল সে চিরদিনের মত এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।,অর্জুনের সাথে।
অর্জুনের সঙ্গে আলাপ টা অদ্ভূত ভাবে। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে তখন । প্রায় চোখে পড়তো একটি ছেলেকে খুব বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কখনো লাইব্রেরী কখনো খেলার মাঠে । ছেলেটার চোখ দুটো য় যেন স্বপ্ন মাখা। খুব ভালো লাগতো তিতিরের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। বন্ধু দের থেকে জেনেছিল ছেলেটার নাম অর্জুন। মহাভারতের অর্জুন তার স্বপ্নের নায়ক। নাম টা জানা মাত্র তিতির আরো বেশি
করে ভালোবেসে ফেললো অর্জুনকে। সারা দিন রাত্রি তার আবর্তিত হতে লাগলো অর্জুন কে ঘিরে ।তার ক্লাসের বন্ধুরাও জেনে গেল ব্যাপার টা। অর্জুন কে দেখলেই তিতিরের মনে হত “অর্জুন তুমি অর্জুন”
কিন্তু কিছুই জানাতে পারে নি সে অর্জুনকে। অর্জুন যখন খেলতো সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দূর থেকে তার খেলা দেখতো। যেমন পড়াশোনা য় তেমনি খেলাধূলা য় ভালো ছিলো অর্জুন। তার বন্ধুরা অর্জুন সম্বন্ধে অনেক খবর জোগাড় করেছিল। অর্জুনদের বাড়ি বেশ দূরে। কি একটা গ্রামে। অর্জুন এখানে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। সেটা শুনে তিতির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল যে সে যেন ডুরে শাড়ি পরা এক গাঁয়ের বধূ। মাথায় ঘোমটা দিয়ে গ্রামের পথে হেঁটে চলেছে, সঙ্গে অর্জুন। সে জন্ম থেকেই দর্জি পাড়ায় বড় হয়েছে,গ্রামের ছবি সে বইতে আর সিনেমায় দেখেছে। প্রায় ই স্বপ্ন দেখত সে , নিজেকে গ্রামের বউ বলে ভাবতো। খুব ভালো লাগতো তার।তখন পড়ায় মন নেই, চোখে ঘুম নেই, পাগল পাগল অবস্থা তার। 

Valobashar Golpo Bangla 

কলেজের পরীক্ষায় রেজাল্ট ও খুব খারাপ হোলো তিতিরের বাড়িতে খুব বকাবকি শুরু করলো সবাই, তাকে বাদল স্যার এর কোচিং ক্লাসে পাঠানো হোলো। তাতেও তার লেখাপড়ায় তেমন কিছু উন্নতি হোলো না। শয়নে স্বপনে অর্জুন। বন্ধু মারফত অর্জুনের কানেও কিছু গিয়ে থাকবে, কিন্তু সে নির্বিকার। কিন্তু তিতিরের তখন মনের এমন অবস্থা…যে করেই হোক অর্জুনকে পেতেই হবে। একদিন তিতির কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে বন্ধুদের সাথে। আজ অর্জুন কলেজে আসে নি। মনটা ভালো লাগছে না তিতিরের। হঠাৎ দেখে রাস্তার ধারের একটা ওষুধের দোকান থেকে অর্জুন বেরিয়ে এলো মাথায় ব্যান্ডেজ। 
তাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো অর্জুন। অর্জুনের সঙ্গে আরো দুটো ছেলে ছিল । তাদের কি ইশারা করে সিধে চলে এলো তিতির দের সামনে। তিতিরের বন্ধু সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করলো..”একি! আপনার মাথায় কি হোলো। ?” অর্জুন বললো …”ও কিছু না খেলতে গিয়ে মাথায় একটু চোট লেগেছে আজ। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম , পাখি টাকে আজ দেখিনি যে….” কথা টা অসমাপ্ত রেখেছিলো অর্জুন। তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কি তাইতো?” অর্জুনের কথা শুনে তিতির মূর্ছা যাবে কিনা ভাবলো। কিন্তু বাস্তবে মূর্ছা যাওয়া খুব একটা সোজা ব্যাপার নয় বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। ওরা দৌড়ে সামনের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লো। অর্জুনের মাথার ব্যান্ডেজটা খানিকটা ভিজে গেছে । মোটেই ভালো কথা নয়। নতুন করে ব্যান্ডেজ করাতে হবে আবার। আপাতত বৃষ্টি না থামলে কিছুই করা যাবে না। ওরা সবাই লস্যি নিয়ে জমিয়ে গল্প শুরু করে দিলো। আর তিতির? সে মুগ্ধ হয়ে অর্জুনের কথা শুনে যাচ্ছে। এত সুন্দর কথা বলতে পারে অর্জুন!!
আশ্চর্য !! যখন বাড়ি ফিরলো তখনও যেন অর্জুনের কথাগুলি অনুরণিত হয়ে চলেছে তার মনে । সেও কত কথা বলে চলেছে অর্জুনের সাথে । তখনও বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।
” সে কথা শুনিবে না কেহ আর 
নিভৃত নির্জন চারিধার
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অনিবার-
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।”
সেই শুরু হোলো। তারপর প্রায় রোজই তাদের দেখা হতে লাগলো। অর্জুনের ভালোবাসায় তিতিরের নবজন্ম হলো।

Valobashar Golpo Kotha

ইতিমধ্যে অর্জুন খুব ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে গেল। তিতিরের সেই একই অবস্থা।রেজাল্ট আরো খারাপ হোলো তার । খালি মাথায় তার বিয়ের চিন্তা ।কবে যে অর্জুনের বউ হতে পারবে সে,কে জানে? ছোটবেলা থেকেই তার খুব বিয়ে করার শখ ছিলো। এ নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। একবার তো তিতির মায়ের শাড়ী পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ পরে নিজেকে আয়নায় দেখছিলো। তার দিদি দেখতে পেয়ে সবাইকে চুপিচুপি ডেকে এনে দেখায়। তারপর তিতিরের যা অবস্থা হয়েছিল বাড়িতে তা আর বলার নয়। তিতির এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে তাদের এই ভালোবাসা বাড়ি থেকে কোনোমতেই মেনে নেবে না। অর্জুন তাকে নিজেদের বাড়ির সব কথাই খুলে বলেছে। খুবই সাধারণ অবস্থা তাদের । অর্জুনের বাবা গ্রামের স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই। তাদের একটা মুদির দোকান ও আছে। সেটা অর্জুনের কাকা দেখাশোনা করেন। বাড়িতে অর্জুনের নিজের আরেক ভাই ও বোন আছে। আর কাকার এক ছেলে।
তাছাড়া অর্জুনের ঠাকুমা আছেন। অর্জুন ঠাকুমা অন্ত প্রাণ। অর্জুন নাম ঠাকুমারই রাখা। অর্জুনের বাবা নাকি একটু রাগী প্রকৃতির, মা খুব শান্ত , খুব গুণী। কি  সুন্দর আসন বানান, বড়ি , আমসত্ত্ব , আচারে গ্রামে তিনিই সেরা। তাঁর মতো আলপনা দিতে কেউ পারে না। 
তিতির মুগ্ধ হয়ে অর্জুনের বাড়ির কথা শুনতো। অর্জুনের কাকা কাকিমা নিরীহ ভালোমানুষ। তিতির অর্জুনের বাড়ির সবাইকে এইভাবে মনে মনে চিনে নিয়েছিলো। খুব ইচ্ছে করতো তার ওখানে গিয়ে থাকতে। অর্জুনের আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছে। কিন্তু তিতির বিয়ে করতে চায়। তিতিরের ইচ্ছের কাছে হার মেনে গেল অর্জুন। তাদের গ্রামের এক স্কুলে চাকরিও নিয়ে নিলো সে। দুদিন আগে তারা 
রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিয়েছে কয়েকজন বন্ধুর উপস্থিতিতে। তারপর তারা সবাই মিলে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে যে যার নিজের বাড়ি।
কাল সকালে তিতির চিরকালের জন্যে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। 
সকালে কোচিং ক্লাসে যাচ্ছে বলে বেরোবে। বড় পার্কের সামনে অর্জুন অপেক্ষা করবে তার জন্যে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। দাদুর কাশির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো তিতিরের। ভোর হয়ে গেছে বোধহয়, আকাশটা বেশ পরিষ্কার লাগছে। আর একটু পরেই..
বড্ড কাশছে দাদু। দাদুর ঘরে ঢুকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দাদু তিতিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। তিতিরের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। দাদু কিছু বুঝতে পারলেন নাকি? 
তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে লাগলো তিতির। আর কিছু ভাবার সময় নেই । স্নানটা করে নিলো সে। সারাদিন আর স্নান করার সুযোগ হবে কিনা কে জানে। অর্জুনের বাড়ি অনেক দূর।
অনেক দূর..অনেক দূর
ডাকছে তাকে কোন সুদূর।
সে সুদুরের ডাক উপেক্ষা করার তার সাধ্য নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে রাস্তায় পা রাখলো তিতির। তারপর একবারও বাড়ির দিকে পিছন ফিরে না তাকিয়ে এগিয়ে গেল সে বড় পার্কের দিকে। বড় পার্কের সামনে এসে তিতির দেখলো তখনো অর্জুন এসে পৌঁছয় নি।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সবে সোয়া আটটা। অর্জুন তাকে সাড়ে আটটায় আসতে বলেছিল। সে নিজেই তাড়াহুড়ো করে আগে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। এখন পার্কের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কারোর চোখে পড়ার সম্ভাবনা। তাই সে পার্কের মধ্যে ঢুকে একটা বেঞ্চে চুপ করে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো।
মনটা খুব খারাপ লাগছে এখন। কিন্তু এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে না এলে সে কোনদিন অর্জুনকে নিজের করে পেতো না। তার বাবা তো কোনদিন অর্জুনকে মেনে নিতেন না। খুব রাশভারী মানুষ তার বাবা। বংশকৌলীন্য নিয়ে সদা গর্বিত মানুষ। তার বাবার দাদুর নামে রাস্তা আছে প্রকাশ মুখার্জী লেন।
তার লিলি পিসি নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিল বাড়িতে না জানিয়ে। কি যে অশান্তি চলেছিল বাড়িতে। তখন ঠাকুমা বেঁচে। ঠাকুমা তো একপ্রকার অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন। কদিন পর লিলি পিসি প্রবীর পিসেমশাই কে নিয়ে বাড়িতে এসেছিলো। তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে দিনটার কথা তিতির ভুলতে পারবে না কোনদিন। তিতির অবশ্য কলেজ থেকে কয়েকবার লিলি পিসির বাড়িতে ঘুরে এসেছে। বাড়িতে কেউ জানতে পারে নি। লিলি পিসি কিন্তু খুব ভালো ই আছে। পিসেমশাই খুব ভালো মানুষ। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হলেও লিলি পিসি বেশ সুখেই আছে বোঝা যায়। একটি ছেলেও হয়েছে।তিতিরের সেদিন মনে হয়েছিল, সুখ জিনিসটা একটা আলাদা ব্যাপার, তার জন্যে খুব একটা পয়সা টয়সা লাগে না বোধ হয়।

ভালোবাসার গল্প কাহিনী

সেও তো অর্জুনকে কে ভালোবেসে সবাই কে ছেড়ে চলে এলো। অর্জুন ও তাকে খুউব ভালোবাসে। লেখাপড়ায় এতো ভালো ছেলে তার সামনে কত উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিল। কিন্তু তিতিরকে বিয়ে করবে বলে সব ছেড়ে গ্রামের এক অখ্যাত স্কুলে চাকরী নিলো। তিতির এই ভালোবাসার মর্যাদা রাখবে চিরদিন।
অর্জুনের আসতে বেশ দেরী হচ্ছে, নটা বেজে গেছে। ফোনেও বিজি আসছে।  পার্কের বেঞ্চ গুলোতে বেশ রোদ পড়ছে এবার। আর বসে থাকা যাচ্ছে না। উঠে দাঁড়ালো তিতির, হাঁটতে শুরু করলো সে। হাঁটতে হাঁটতে আবার পার্কের বাইরে যেতেই অর্জুনকে দেখতে পেল। ছেলেটা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসছে। ঘেমে লাল হয়ে গেছে। পাগল ছেলে এসেই তিতিরের সামনে ঝুঁকে বললো “বউ কথা কও” তারপর তার হাতে একটা বড়ো প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে একটা বাস কে হাত দেখিয়ে থামালো তারপর তিতিরের হাতটা ধরে বাসে উঠে পড়লো। শিয়ালদা স্টেশনে চা আর কেক খেতে খেতে মোবাইলে র সুইচটা অফ করে দিলো তিতির। তারপর চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো অর্জুন তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে তাকাতে দেখে প্যাকেটটার দিকে ইশারা করলো। তিতির প্যাকেটটা খুলে দেখলো ..একটা শাড়ি..একটা লাল রঙের বেনারসি।
ট্রেনে ওঠার পর অর্জুন তাকে অনেক কথা বলছিলো। তাদের গ্রামের জাগ্রত সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির আছে। সেখানে প্রনাম করে তাকে সিঁদুর পরিয়ে দেবে অর্জুন। তারপর তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। বাড়িতে অবশ্য সবাই জানে। ইতিমধ্যে শিয়ালদা স্টেশনের টয়লেটে
গিয়ে তিতির শালোয়ার কামিজ পাল্টে বাড়ি থেকে আনা একটা শাড়ি পরে নিয়েছিল। তিতির অন্য কথা ভাবছিলো, এতক্ষনে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। মা হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তিতিরের চোখ ছলছল করে উঠলো। সে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে দেখলো অর্জুনেরও চোখ দুটো ছলছল করছে। দুজোড়া সজল চোখের মিলন হোলো নতুন করে। 
“সব পথ এসে মিলে গেল শেষে
তোমার দুখানি নয়নে ..নয়নে..নয়নে।”
গ্রাম নব নিঝুমপুর।
তারা যখন ট্রেন থেকে নামলো তখন বিকেলের পড়ন্ত আলো। একেই বোধহয় গোধূলি লগন বলে। ছোট্ট একটা স্টেশন। খালি তারাই নামলো ট্রেন থেকে । তিতির তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো সব। লোক জন বিশেষ চোখে পড়লো না। তবে গ্রামের নামটি বেশ “নব নিঝুমপুর” , কেমন রূপকথার দেশ মনে হয়। এখানেই সে থাকবে এখন। সে সত্যিই এখন গ্রামের বউ। অর্জুন তিতিরের হাত ধরে এগিয়ে গেল। তিতির এবার সত্যিই গ্রামের পথে হাঁটছে অর্জুনের সাথে। যে স্বপ্ন সে এতদিন দেখে এসেছে। এখনো কোনো বাড়ি চোখে পড়ে নি। খালি ধূ ধূ মাঠ।
একটা জায়গায় এসে তারা দাঁড়িয়ে পড়লো। একটা নদী ,তার পারে একটা বেশ পুরোনো মন্দির, দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির। 
অর্জুন বললো “এই নদীর নাম কি জানো? ” ভালোবাসা নদী” এই নদীতে স্নান করলে নাকি ভালোবাসা অটুট থাকে। এখন জল খুব কম, বর্ষাকালে জল খুব বেড়ে যায়। তখন এসে একবার স্নান করা যাবে কি বলো?” 
দেবী সর্বমঙ্গলা, ভারী সুন্দর বিগ্রহ। মা যেন হাসছেন তাদের দিকে চেয়ে। মন্দিরে লোকজন কেউ নেই। একটা প্রদীপ জ্বলছে মায়ের সামনে। সেই প্রায়ান্ধকার মন্দিরে দেবী মায়ের সামনে বেদীর উপর রাখা সিঁদুর দিয়ে তিতিরের সিঁথি রাঙিয়ে দিলো অর্জুন। তিতির কাঁদতে কাঁদতে মন্দিরের মেঝে তে বসে পড়লো। খুব কাঁদছে সে , মা বাবার কথা খুউব মনে হচ্ছে। বাবা রেগে গেলে খুব গলা খাঁকারি দেয়। আজ তো গলা খাঁকারি দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে বোধহয়। আর মা? মা খুব কাঁদছে, ভীষণ কাঁদছে আর দাদু?কাশি টা বাড়লো নাকি দাদুর? আর দাদা, দিদি,ভাই?তারা খোঁজা খুঁজি করছে কি তাকে?
অর্জুন চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো। এখন এগিয়ে এসে তাকে তুলে দাঁড় করালো। তারপর বললো..এরপরেই আমাদের বাড়ি কিন্তু। আমাকে কিছু বলবে না তিতির? তিতির অশ্রুসজল চোখ দুটো তুলে অর্জুনের দিকে তাকালো, তারপর বললো” তোমাকে খুউব ভালোবাসি অর্জুন ।”অর্জুন হেসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো ..”তুমি আমার মনের মতো। এমনই থেকো তুমি, সারাজীবন।”
অর্জুন তিতিরের হাত ধরে মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়লো। মন্দিরের পেছন দিকে যেতেই চোখে পড়লো একটু দূরে কিছু ঘরবাড়ি। মানুষজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে এবার। খানিকটা এগিয়ে যেতে চোখে পড়লো, টর্চ হাতে কারা যেন এগিয়ে আসছে । অর্জুনের বাড়ির লোকজন। তাঁরা অর্জুনের সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এমন সময় একটি মহিলা এসে তিতিরের হাত ধরলো। অর্জুন বললো আমার কাকিমা তিতির। তিতির তাঁকে প্রনাম করে এগিয়ে গেল । 
একটা বেশ বড় উঠোন। উঠোন ঘিরে বেশ কয়েকটা ছোট বড় ঘর। উঠোনের একদিকে প্যান্ডেল বাঁধা। কতগুলো বাচ্ছা সেখানে খেলা করছে। কয়েকটা বাল্বের আলোয় একটা বেশ আলো আঁধারীর সৃষ্টি করেছে। অর্জুনের মা এগিয়ে এলেন তিতির কে বরণ করতে। বেশ মা মা দেখতে তাঁকে। তারপর কিছু ঘটনা যেন স্বপ্ন মনে হোলো তার। তিতির বাড়ির সবাইকে চিনে নিলো। অর্জুনের বাবা খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। ঠাকুমা খুব মজার মানুষ। কাকা নিরীহ প্রকৃতির। কাকিমা খুব আপন করা মানুষ। অর্জুনের বোন রত্নাবলী ভারী মিষ্টি মেয়ে। বাড়িতে আরো কয়েকজন বয়স্ক মানুষ রয়েছেন। তাঁরা বোধহয় আশপাশের বাড়ি থেকে এসেছেন। তিতিরের শাশুড়ি তিতিরের হাতে শাঁখা, পলা, নোয়া, চুড়ি ইত্যাদি পরিয়ে দিয়ে গলায় একটা হার পরিয়ে দিলেন । 
সেই সময় তিতিরের চোখ গেল দরজার কাছে , ভিড়ের মধ্যে ঘনার মা। বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তিতির এর বিস্মিত দৃষ্টি অনুসরণ করে অর্জুনের বোন রত্নাবলী বলে উঠলো ও মিনতি কাকিমা, আমাদের পাড়ায় থাকে কলকাতায় চাকরি করে। ঘনার মা র নাম যে মিনতি এই প্রথম জানলো তিতির। ঘনার মা এগিয়ে এসে বললো …”একি কান্ড কোরেছো গো দিদিমণি?”
তিতিরের খুব অস্বস্তি লাগছিলো। অর্জুনের কাকিমা ঘনা র মা কে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো।সবার আশীর্বাদ করা হয়ে যাওয়ার পর খাওয়া দাওয়ার পালা। কি সুন্দর ডাল ভাত,মাছভাজা , মাছের ঝোল দিয়ে কলাপাতায় করে সবাই মিলে খাওয়া হোলো। মাছ নাকি অর্জুনদের পুকুরের।অর্জুনদের পুকুর আছে সে জানতোই না। অর্জুন কোনদিন বলেনি তাকে। দুস্টু ছেলে একটা।
সেদিন রাতটা ভারী সুন্দর কাটলো। নিয়মমতো সেদিন তাদের বাসর রাত। একটা বিরাট ঘরে সারা মেঝে জুড়ে একটা ঢালাও বিছানা করা হয়েছে। সেই বিছানায় তিতির, অর্জুন , অর্জুনের ঠাকুমা আরো কয়েকটি বৃদ্ধা,অর্জুনের ভাই বোনেরা , কয়েকটি অল্প বয়সী মেয়ে কয়েকটি অল্প বয়সী বউ। সবাই নাকি আজ বাসর জাগবে, গান বাজনা হবে। তিতির আগে কোনদিন বাসর নামে ব্যাপারটা দেখে নি, শুনেই এসেছে। খুব মজা হয় এটা সে জানতো। তাই সে মজাটা দেখার জন্যে গুছিয়ে বসলো। অর্জুন কোলের উপর বালিশটা টেনে নিয়ে বললো …” উদ্বোধন সঙ্গীত চারু ঠাকুমা।”  চারু ঠাকুমা নামক বৃদ্ধাটি এগিয়ে এসে মাঝখানে বসলেন। আর শুরু করলেন গান..হরে কৃষ্ণ নাম দিলেন প্রিয় বলরাম..
তারপর অর্জুনের ঠাকুমা গান ধরলেন .”.বাসরের দীপ আর আকাশের তারাগুলি..নিবিড় নিশীথে যবে জ্বলবে.”.কি যে অপূর্ব গলা অর্জুনের ঠাকুমার। তিতির শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল। এমনটা সে কখনও দেখে নি…শোনেও নি। তার যে মুগ্ধ হবার আরো কিছু বাকি ছিল । এরপর পাড়ার একটি বউ মধু মালতি ডাকে আয় ..গানটি শোনানোর পরে অর্জুন শুরু করলো তার উদাত্ত গলায় গান…”ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে..আমার নামটি লিখো…তোমার মনের মন্দিরে।”
তিতির আবিষ্ট হয়ে গেল ভালোবাসায়। অর্জুন এত ভালো গান গায়!! তার আর কোনদিকে মন ছিল না। সে মুগ্ধ হয়ে শুনছে…”আমার স্মরণ শুভ সিন্দুরে ..একটি বিন্দু এঁকো তোমার ললাটচন্দনে।”
জানলার বাইরে শ্বশুরমশাই এর গম্ভীর গলার স্বর কানে এলো তিতিরের। তখন রত্নাবলী নাচছে ..আয় তবে সহচরী.. আরেকটা আওয়াজ মনে হোলো যেন ঘনার মার । 
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তিতির জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো বেশ সকাল হয়ে গেছে। কালকের সারাদিনের ক্লান্তিতে অঘোরে ঘুমিয়েছে সে এতক্ষন। আশে পাশে তাকিয়ে সে অর্জুনকে দেখতে পেলো না। কোথায় গেছে কে জানে।
অর্জুনের কাকিমা ঢুকে বললেন, চলো তিতির তোমাকে সব দেখিয়ে দি। একেবারে স্নান করে নাও তুমি। এমন সময় অর্জুন ঘরে ঢুকতেই কাকিমা বললেন “তুই অন্য ঘরে যা, আজ বউয়ের মুখ দেখতে নেই যে।” অর্জুন বললো “সে চলবে না কাকিমা আজ আমি বউ এর মুখ দেখবো ই দেখবো।” কাকিমা অর্জুনকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে তিতির কে নিয়ে বাইরে এলেন।
দিনের আলোয় বাইরে টা দেখে তিতিরের চোখ জুড়িয়ে গেল। একটা বড় উঠোনকে ঘিরে ঘরগুলো। একটু ছড়ানো মতো। একদিকে বাগান, কত ফুল ফুটে আছে। উঠোনের একদিকে একটা বড় পেয়ারা গাছ। কত পেয়ারা হয়ে আছে তাতে। একদিকে একটা একটু ছোট ঘর, সেটা রান্নাঘর বলে মনে হয়। তার দাওয়ায় তিনটি বউ বসে সবজি কাটছে। উঠোনের একদিকে আবার দুটো হাস ঘুরে বেড়াচ্ছে ।কি যে ভালো লাগছে তিতিরের। মনটা অদ্ভুত রকমের এক ভালোলাগায় ভরে গেছে তার।
একটা ফাঁকা মতো ঘেরা জায়গায় একটা টিউবওয়েল। আর একটা ঘর। ওটাই বাথরুম। কি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।আশেপাশে আবার কিছু ফুলের গাছে সাদা গোলাপি রঙের ফুল ফুটেছে বোধ হয় দোপাটি ফুল। ভারী সুন্দর দেখতে লাগছে। তিতির অবাক হয়ে সব দেখছিলো।
রত্নাবলী হাতে শাড়ী ব্লাউজ ইত্যাদি নিয়ে এসে তিতিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো স্নান করে এগুলো পড়ে নেবে, কেমন? দাঁড়াও আমি তোমাকে টিউবওয়েলটা পাম্প করে দি। বাবা ঠাকুরঘরে রয়েছেন, তোমার সাথে দুএকটা কথা বলতে চান।
তিতির স্নান সেরে রত্নাবলীর আনা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়িটা পড়লো। তারপর ভিজে জামাকাপড় উঠোনের তারে মেলতে গিয়ে দেখলো উঠোনে দুটো বেড়াল ছানা কি সুন্দর খেলা করছে। রত্নাবলী বললো ওদের নাম নাকি ফুলি আর টুলি ওদের পোষা বেড়াল পুষ্পলতা র ছানা। তিতিরের ইচ্ছে করছিল ওদের কোলে করে আদর করতে। কিন্তু অর্জুনের বাবা ঠাকুরঘরে অপেক্ষা করছেন , তাকে কি যেন জিজ্ঞেস করবেন বলে। 
তিতিরের বুকের ভেতরটা ভয়ে গুর গুর করে উঠলো। ঘরে যেতেই শাশুড়িমা হেসে এগিয়ে এলেন, একটা রেকাবি তে মুড়ি সন্দেশ আর কলা দিয়ে বললেন, বৌমা সিঁদুর পরে নাও ওই যে আয়নার সামনে রাখা আছে, তারপর জলখাবারটা খেয়ে নাও। তিতির যখন আয়নায় মুখ দেখে সিঁদুর পরছিলো তখন অর্জুন ঘরে ঢুকে ওকে সিঁদুর পরতে দেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তারপর বলল “বাবা তিতির কে ডাকছেন।” শাশুড়ি মা বললেন …”তুই বাবাকে বল ও জলখাবার খেয়ে এক্ষুনি যাচ্ছে।”
তিতির রত্নাবলী রসাথে ঠাকুরঘরের দিকে যেতে যেতে দেখলো রান্নাঘরের দাওয়ায় দুটো বউ বসে বিরাট বঁটিতে মাছ কূটছে। আর সামনে বসে ফুলি আর টুলিকে নিয়ে তাদের মা পুষ্পলতা মাছ কোটার ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছে। ঠাকুরঘরটা একটু দুরেই , উঠোনে নেমে তিনটি ঘর ছেড়ে। তিতির মনে মনে হিসেব করে নিলো। ঠাকুরঘরের সামনে যেতেই ধূপ ধুনোর গন্ধ আর ফুলের গন্ধ। একটা গন্ধরাজ
ফুলের গাছে কত ফুল ফুটে আছে। তিতির হাঁ করে সব দেখছিলো। ঠাকুরঘরটা বেশ বড়। ভেতরে অনেকটা জায়গা। রত্নাবলী বলছিলো পালাপার্বণে তাদের বাড়ি ভগবানের নামগান হয়। গ্রামের সবাই আসে তাদের বাড়িতে।
ঠাকুরঘরে শ্বশুর মশাই এর সাথে আরো দুজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিতির বিগ্রহ দেখছিলো। রাধাগোবিন্দ, মা দুর্গা,মহাদেব কতরকম বিগ্রহ। শ্বশুরমশাই বললেন, “প্রণাম করো বৌমা এনারা আমাদের গৃহের অধিস্ঠাত্রী দেব দেবী। আমাদের রক্ষা করেন।”
তিতির প্রনাম করে দেখলো অন্য দুজন ভদ্রলোক ঘর থেকে চলে গেছেন। সামনে রাখা আসন দেখিয়ে শ্বশুরমশাই বললেন…”বোসো। আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাই না বৌমা, কিন্তু কটা কথা আমার জানা দরকার, খুব দরকার। প্রথমে জিজ্ঞেস করি, বিয়ের ব্যাপারে তোমার নিজের পূর্ন সম্মতি ছিলো তো?”
তিতির মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে তাকিয়ে রইলো। দ্বিতীয় প্রশ্ন ..”তুমি কলকাতা ছেড়ে আমাদের এই গ্রামে থাকতে পারবে তো?” তিতিরের চোখে জল আসছিলো। মাথা নেড়ে কোনরকমে হ্যাঁ বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো তিতির। তিতির যদি তাকাতো দেখতে পেতো একটি বড় মায়াময় দৃষ্টি তাকে ঘিরে আছে। 
একটু পরে তিতিরের সামনে একটি খাতা আর পেন দিয়ে বললেন “তোমার বাবার নাম আর ঠিকানা টা লিখে দাও বৌমা।”
তিতির নাম ঠিকানা লিখে দিতে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন খাতাটির দিকে। তারপর সম্বিত ফিরতে তিনি বললেন” ওরে রত্নাবলী বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা আর তোর শরৎকাকুকে পাঠিয়ে দে একবার। বলবি খুব দরকার আছে।”
তিতির ঘরে যেতে যেতে দেখলো উঠোনে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। ঘনার বাবাও আছে তার মধ্যে। আর ঘনা এক হাতে পেন্টু ধরে পেয়ারা খেতে খেতে তাকিয়ে দেখছে , তাকে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে মুখব্যাদান করে তাকিয়ে রইলো। 
দুপুর বেলায় আবার কলাপাতায় করে খাওয়া। তিতিরের খুব ভালো লাগছে খেতে। বাড়িতে মা ধমকে ধমকে খাওয়া তো তাকে। খাবার পাতে ফেলে ছড়িয়ে উঠে পড়তো অর্ধেক দিন। আর এখানে কি মজা করে খাওয়া হচ্ছে। আজ রান্না হয়েছে শাক ভাজা, মুগের ডাল , 
এঁচোরের তরকারী, মাছের ঝোল, চাটনী আর পায়েস। বড় তৃপ্তি করে খেয়ে ঘরে গেল। অর্জুনকে ওই খাওয়ার সময় ই দেখলো। খেতে খেতে আড়চোখে দেখছিলো। ঘরে সাবেকি খাটে পরিপাটি বিছানা। বালিশের কভারে এমব্রয়ডারি করা। তিতির শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
স্বপ্নে তলিয়ে যাচ্ছে তিতির …কলেজ…পরীক্ষা চলছে…সবাই কত কিছু লিখে যাচ্ছে খাতার পাতায়..তিতির কিছুই লিখতে পারছে না। কিছুই পড়াশোনা করেনি সে। আর একটা যদি সুযোগ পেত সে..খুব দুঃখ হচ্ছে..হঠাৎ সামনে অর্জুন…অর্জুন বলছে” তুমি আবার পরীক্ষা দেবে তিতির আমি তোমাকে পড়াবো। দেখবে এবার ঠিক পারবে। “
ঘুমটা ভেঙে গেল তিতিরের। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ঘরে কাদের কথাবার্তা শুনতে পেল তিতির। অর্জুনের ঠাকুমার সাথে আরো দুটি বউ। একটি বউ কে উদ্দেশ্য করে ঠাকুমা বললেন ..”.পারুল বউ তুমি নাতবউ এর চুলে খোঁপা বেঁধে দাও। তিতির কে উদ্দেশ্য করে বললেন 
জানিস নাত বউ পারুল বউ খুব সুন্দর খোঁপা বাঁধতে পারে…ওর হাতের খেজুর ছড়ি, কলেজ খোঁপার খুব খ্যাতি রে”। তিতির অবাক হয়ে শুনছিলো, সে আগে কোনদিন খোঁপা বাঁধে নি। তার মাকেও বিশেষ খোঁপা বাঁধতে দ্যাখে নি। একটা বিনুনি করে রাখেন তার মা। পারুল বউ কি সুন্দর করে তার মাথায় একটা খোঁপা করে দিলো। সিঁথি তে সিঁদুর দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো তিতির।
উঠোনে একদিকে ভিয়েন বসেছে। পান্তুয়া, রসগোল্লা এইসব তৈরী হচ্ছে। অর্জুনকে কোথাও দেখতে পেলো না সে। তবে একটা জিনিস সে বুঝেছে অর্জুনদের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো।আকাশে অনেক তারা ফুটেছে সেই দিকে তাকিয়ে নিজের বাড়ির কথা মনে হোলো। আচ্ছা সে আর অর্জুন যদি যায়, তাদের ও কি বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না,লিলি পিসি আর পিসেমশাই এর মতো?তারা দুজন কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে? আর কোনদিন বাড়ির কারো সাথে তার দেখা হবে না?
খুব কান্না পাচ্ছে এবার। তিতির দেখলো পুষ্পলতা কে কোলে নিয়ে রত্নাবলী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো “বৌদি তোমার শাড়ী ব্লাউজ নিয়ে আসি। চোখমুখ ধুয়ে নাও।”
টিউবওয়েল পাম্প করতে করতে রত্নাবলী বললো …”মন খারাপ কোরো না বৌদি। দাদা তোমাকে মন খারাপ করতে বারন করেছে। কাল তোমার বৌভাত। সকাল বেলায় মামারা আর মাসীরা এসে যাবেন। পিসির আসতে দুপুর হয়ে যাবে দূরে থাকেন তো।”
আজ তিতিরের বৌভাত। পারুল বউ সকালে এসে সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে সাজিয়ে দিয়েছে তাকে। এখন একটা ঘরে তার সামনে অর্জুন দাঁড়িয়ে। পায়জামা পাঞ্জাবী পরেছে আজ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। অর্জুনের মাসী কাঁসার থালায় ভাত আরো কিসব আর সুন্দর একটা কমলা রঙের শাড়ি অর্জুনের হাতে দিয়ে বললেন এটা তিতির কে দিয়ে বল..”আজ থেকে তোমার ভাত কাপড়ের ভার নিলাম। “
অর্জুন বললো..”এমন কথা বলবোই না, ও নিজ ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবতী হয়ে থাকুক। বরং বলি…তোমার সারা জীবনের সুখের দায়িত্ব নিলাম তিতির। তোমাকে সারাজীবন খুউব ভালোবাসবো।” 
তিতির অস্ফুটে বললো ..”আমিও।”
আজ অর্জুনদের বাড়ী আলোর মালা পরে সেজে উঠেছে। গাছগুলোতে টুনি আলোর মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। তিতিরও আজ নবসাজে সেজে উঠেছে। পারুল বউ চমৎকার পানপাতা খোঁপা বেঁধে দিয়েছে তাকে। শাশুড়ি মা এসে খোঁপাতে কি সুন্দর একটা সোনার গয়না পরিয়ে দিলেন। গয়না টার নাম নাকি বাগান। তারপর পারুল বউ এবং আরেকটি বউ তাকে লাল বেনারসিটা পরিয়ে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দিলো। ভ্রূর মধ্যিখানে বড় সিঁদুরের টিপ। তাকে ঘিরে চন্দনের কলকা ।গলায় রজনীগন্ধার মালা। তিতিরকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। তিতির এমনিতেই বেশ সুন্দরী। আজ তার থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না কিছুতেই। 
অর্জুন খালি উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। একবার এসে চুপিচুপি বলে গেছে কানে কানে…”আজ আমাদের কি, মনে আছে তো?”
তিতির আজ উন্মনা। রত্নাবলী আর অন্য মেয়ে বউ রা তার সামনে বসে আছে। মাইকে গান বাজছে। সবাই উৎসবে মাতোয়ারা। তিতিরের চোখ ছলছল করছে। আজ যদি…
তিতিরের চিন্তাজাল কেটে গেল, কোন পরিচিত গলার আওয়াজে। কারা যেন কথা বলছে ঘরের বাইরে। শ্বশুরমশাই বেশ জোরেই কথা বলছেন…”আরে আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তারপর তোর নাম দেখে নিশ্চিত হোলাম বৌমার বাবা আমার বন্ধু অরবিন্দ ছাড়া আর কেউ নয়। তাই শরৎকে তোর কাছে পাঠালাম চিঠি দিয়ে। সেই কলেজ ছাড়ার পর এই দেখা। আর দেখা হবেই বা কি করে ? কলেজ ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এলাম। সেই থেকেই… “
“আসুন আসুন” 
এ কাদের দেখছে তিতির? মা..বাবা..দাদা..দিদি..ভাই আর দাদুর হাত ধরে লিলি পিসি না? সঙ্গে প্রবীর পিসেমশাই..ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না তিতির ..চোখ ভীষন ঝাপসা। মা এগিয়ে আসছে তার দিকে। বাবারও চোখে জল। এই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখলো তিতির।
বিশ্ব চরাচর স্তব্ধ। খালি ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে। রজনীগন্ধা, জুঁই, গোলাপ ফুলের সাথে আরো একটা সুগন্ধ। সে সুগন্ধের তুলনা মেলা ভার…সে হোলো যুগ পরিবর্তনের সুগন্ধ…নব চেতনার সুগন্ধ।
আমার গল্প শেষ
থাকুক তার রেশ
ফিরবো আমি আবার
গল্প নিয়ে হাতে
বন্ধু তোমরা সবাই
থেকো আমার সাথে।
সমাপ্ত ।ঝুমা ভট্টাচার্য্য।
Tags – Bangla Golpo, Valobashar Golpo, Bengali Love Story

Share This Article