Jibanananda Das Er Kobita – জীবনান্দন দাশের কবিতা সমগ্র

Bongconnection Original Published
29 Min Read


 Jibanananda Das Er Kobita – জীবনান্দন দাশের কবিতা সমগ্র

Jibanananda Das Er Kobita - জীবনান্দন দাশের কবিতা সমগ্র
Loading...

        আবার আসিবো ফিরে
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে -এই বাংলায়  
 হয়তো মানুষ নয় -হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;  
 হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে  
 কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;  
 হয়তো বা হাঁস হব -কিশোরীর -ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,  
 সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;  
 আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে  
 জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;  
  
 হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;  
 হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;  
 হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;  
 রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে  
 ডিঙা রায় -রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে  
 দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।
  
                     
   ====== 
          একদিন কুয়াশার এই মাঠে
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;  
 হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন -গিয়েছে যে শান -হিম ঘরে,  
 অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল -পৃথিবীর এই
মাঠখানি  
 ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে  
  
 আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার
কোলে,  
 আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়  
 ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো
হলে  
 ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?  
  
 সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে নাকি জামের নিবিড় ঘন
ডালে,  
 মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার
বাতাসে-  
 কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে  
 মধুর চাকের নিচে -মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে-
  
                 
====== 

Jibanananda Das Er Kobita Somogro

Loading...

        বুনো হাঁস
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-  
 জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে  
 বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;  
 এক-দুই-তিন চার-অজস্র-অপার-  
  
 রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া  
 এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।  
  
 তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,  
 হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;  
  
 মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;  
 উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক  
  
 কল্পনার হাঁস সব -পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেল পর  
 উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভিতর।
  
         ====== 

Jibanananda Das Er Kobita Bodh

          বোধ 

আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে  
 স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!  
 স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,  
 হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!  
 আমি তারে পারি না এড়াতে  
 সে আমার হাত রাখে হাতে;  
  
 সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,  
 সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়  
 শূন্য মনে হয়,  
 শূন্য মনে হয়!  
 সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!  
 কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে  
 সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা  
 কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা  
 কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ  
 কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ  
 সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!  
 সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর  
 স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙক্ষায় থেকে,  
 শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,  
 শরীরে জলের গন্ধ মেখে,  
 উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে  
 চাষার মতণ প্রাণ পেয়ে  
 কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?  
 স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে  
 মাথার ভিতরে!  
 পথে চলে পারে — পারাপারে  
 উপেক্ষা করিতে চাই তারে:  
 মড়ার খুলির মতো ধ’রে  
 আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার  
 মতো ঘোরে  
 তবু সে মাথার চারি পাশে!  
 তবু সে চোখের চারি পাশে!  
 তবু সে বুকের চারি পাশে!  
 আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!  
  
 আমি থামি —  
 সেও থেমে যায়;  
  
 সকল লোকের মাঝে বসে  
 আমার নিজের মুদ্রাদোষে  
 আমি একা হতেছি আলাদা?  
 আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?  
 আমার পথেই শুধু বাধা?  
 জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে  
 সন্তানের মতো হয়ে —  
 সন্তানের জন্ম দিতে দিতে  
 যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়  
 কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়  
 যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর  
 বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে  
 জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে;  
 তাদের হৃদয় আর মাথার মতন  
 আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন  
 আমার মনের মতো না কি?  
 –তবু কেন এমন একাকী?  
 তবু আমি এমন একাকী!  
  
 হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?  
 বালটিকে টানি নি কি জল?  
 কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে?  
 মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে  
 ঘুরিয়াছি;  
 পুকুরের পানা শ্যালা — আঁষটে গায়ের ঘ্রাণ  
 গায়ে  
 গিয়েছে জড়ায়ে;  
 –এই সব স্বাদ  
 –এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ  
 বয়েছে জীবন,  
 নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন  
 একদিন;  
 এই সব সাধ  
 জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ;  
 চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে —  
 ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,  
 অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,  
 ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;  
 আমার সে ভালোবাসিয়াছে,  
 আসিয়াছে কাছে,  
 উপেক্ষা সে করেছে আমারে,  
 ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন  
 ডেকেছি বারেবারে  
 ভালোবেসে তারে;  
 তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা;  
 আমি তার উপেক্ষার ভাষা  
 আমি তার ঘৃণার আক্রোশ  
 অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের  
 দোষে  
 আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা  
 আমি তা ভুলিয়া গেছি;  
 তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা — ।  
  
 মাথার ভিতরে  
 স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ  
 করে।  
 আমি সব দেবতার ছেড়ে  
 আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,  
 বলি আমি এই হৃদয়েরে;  
 সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?  
 অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?  
 কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার  
 স্বাদ  
 পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ  
 মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!  
 মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!  
 শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!  
  
 এই বোধ — শুধু এই স্বাদ  
 পায় সে কি অগাধ — অগাধ!  
 পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ  
 চায় না সে? করেছে শপথ  
 দেখিবে সে মানুষের মুখ?  
 দেখিবে সে মানুষীর মুখ?  
 দেখিবে সে শিশুদের মুখ?  
 চোখে কালোশিরার অসুখ,  
 কানে যেই বধিরতা আছে,  
 যেই কুঁজ — গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে  
 নষ্ট শসা — পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,  
 যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে  
 — সেই সব।
  
      ====== 


Jibanananda Das Er Shrestho Kobita

Jibanananda Das Er Kobita - জীবনান্দন দাশের কবিতা সমগ্র
    পরস্পর
মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,  
 কহিলাম,শোনো তবে—  
 শুনিতে লাগিল সবে,  
 শুনিল কুমার;  
 কহিলাম,দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,  
 ঘুমানো সে এক মেয়ে—নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে:  
 সেইখানে আর নাই কেহ  
 এক ঘরে পালঙ্কের পরে শুধু একখানা দেহ  
 পড়ে আছে পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুজেখুজে  
 তারপর—তারে আমি দেখেছি গো সেও চোখ বুজে  
 পড়ে ছিল—মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি  
 বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি!  
 আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু পায়ে,  
 পাথরের মতো শাদা গায়ে  
 এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় —  
 কিংবা ছিল—আমার জন্য তা নয়  
 আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে  
 পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে  
 রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে;  
 তবুও হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে  
 তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার!  
 ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার।  
 তারপর কহিল কুমার,  
 আমিও দেখেছি তারে—বসন্তসেনার  
 মতো সেইজন নয়,কিংবা হবে তাই —  
 ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!  
 মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে  
 নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে—  
 (পদ্ম—ভাগীরথী—মেঘনা—কোন নদী যে সে–  
 সে সব জানি কি আমি!— হয়তো বা তোমাদের দেশ  
 সেই নদী আজ আর নাই,  
 আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!)  
 সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায়  
 পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায়  
 কান দিয়ে তার শব্দ শুনে,  
 দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে।  
 দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে  
 সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে  
 রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,  
 আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় —  
 বসন্তের দেশে  
 জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে!  
 জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে  
 নদীর কিনারে!  
 হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন  
 শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্ধবে স্তন  
 রেখেছে সে ঢেকে!  
 বাকিটুকু — থাক্ — আহা, একজনে দেখেশুধু — দেখে না অনেকে  
 এই ছবি!  
 দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! —  
 আজও তবু খুঁজি  
 কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি!  
 কুমারের শেষ হলে পরে —  
 আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন,  
 কহিল সে উত্তর — সাগরে  
 আর নাই কেউ! —  
 জোছনা আর সাগরের ঢেউ  
 উচুনিচু পাথরের পরে  
 হাতে হাত ধরে  
 সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন!  
 ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা  
 আর তারা ঢেউয়ের মতন  
 জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে!  
 ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে।  
 সেই জলমেয়েদের স্তন  
 ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন!  
 তাহাদের মুখ চোখ ভিজে,  
 ফেনার শেমিজে  
 তাহাদের শরীর পিছল!  
 কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল  
 চাঁদের বুকের থেকে ঝরে  
 উত্তর সাগরে!  
 পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরেরগায়ে —  
 কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে!  
 রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্মিক্ করে  
 উত্তর সাগরে  
 বরফের কুঁচির মতন  
 সেই জলমেয়েদের স্তন  
 মুখ বুক ভিজে  
 ফেনার শেমিজে  
 শরীর পিছল!  
 কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল  
 চাদের বুকের থেকে ঝরে  
 উত্তর সাগরে!  
 উত্তর সাগরে!  
 সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে  
 কল্পনার গল্প সব বলে;  
 তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন  
 আবার তো এসে যাবে;  
 এক কবি — তন্ময়, শৌখিন,  
 আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে!  
 আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতনএক ঘুমোনো মেয়ে সে  
 হীরের ছুরির  
 মতো গায়ে  
 আরো ধার লবে সে শানায়ে!  
 সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ —  
 মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ  
 এমনি পড়িয়া রবে পাল্ঙ্েকর পর —  
 ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর।  
 চার পাশে তার  
 রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড়  
 গড়েছে পাহাড়!  
 এ রূপকার এই রূপসীর ছবি  
 তুমি দেখিবে এসে,  
 তুমিও দেখিবে এসে কবি!  
 পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত—  

 শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি—ধারালো হাতির দাঁত!  

 হাড়েরই কাঠামো শুধু—তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা  
 ছিল কই!—তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা  
 তোমার রক্তের তাপ পেয়ে?—  
 আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে!  
 কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা—  
 তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা!  
 হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা;  
 কিন্তু, শোনো—স্বপ্ন নয়— আমাদেরইদেশে কবে, আহা!—  
 যেখানে মায়াবী নাই—জাদু নাই কোনো—  
 এ দেশের—গাল নয়, গল্প নয়, দু—একটা শাদা কথা শোনো!  
 সেও এক রোদে লাল দিন,  
 রোদে লাল—সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন  
 একদিন, সেই একদিন!  
 ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে,  
 ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে  
 চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে!  
 মায়াবীর ঘরে  
 ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে  
 এ ঘুমোনো মেয়ে  
 পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন;  
 রূপ ঝরে যায়—তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন—  
 যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়,  
 যারা ভয় পায়  
 আয়নায় তার ছবি দেখে!—  
 শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে  
 ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,  
 দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে!—  
 দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ,  
 চোখে ঠোঁটে অসুবিধা—ভিতরে অসুখ!  
 কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে!—  
 এ ঘুমোনো মেয়ে  
 পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে  
 দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!..  
 সবাই উঠিল বলে—ঠিক—ঠিক—ঠিক!  
 আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক,  
 আমায় বলেছে সে কী শোনো—  
 আর একজন এই—  
 পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও;  
 বলেছে সে,কাল সাঁঝরাতে  
 আবার তোমার সাথে  
 দেখা হবে?—আসিবে তো?— তুমি আসিবে তো!  
 দেখা যদি পেত!  
 নিকটে বসায়ে  
 কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে—  
 কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে  
 ফিক্ করে হেসে!  
 তবু আরো কথা  
 বলিতে আসিতে—তবু, সব প্রগল্ভতা  
 থেকে যেত!  
 খোঁপা বেঁধে,ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে—  
 সরে যেত, দেয়ালের গায়ে  
 রহিত দাঁড়ায়ে!  
 রাত ঢের—বাড়িবে আরো কি  
 এই রাত!—বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি  
 হয় নাই দেখা  
 আমাদের দুজনার! দুইজন, একা!—  
 বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে!  
 কেন বা এমন করে বলে,  
 কাল সাঁঝরাতে  
 আমার তোমার সাথে  
 দেখা হবে?—আসিবে তো? তুমি আসিবে তো!—  
 আমি না কাঁদিতে কাঁদে দেখা যদি পেত!  
 দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি?—বলিল সে তোমার বকুল,  
 মনে আছে?—এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?  
 হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে’— ভালোবাসো?—হাসি পেল—হাসি!  
 ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’  
 আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে  
 নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে  
 চলে এল কাছে —  
 জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে —  
 আজও এত চুল!  
 চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল  
 একবার চুপে তুলে ধরি;  
 চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি!  
 থুত্নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি —  
 সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি!
  
           ====== 

জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা


   আমি যদি হতাম
আমি যদি হতাম বনহংস;  
 বনহংসী হতে যদি তুমি;  
 কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে  
 ধানক্ষেতের কাছে  
 ছিপছিপে শরের ভিতর  
 এক নিরালা নীড়ে;  
 তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে  
 ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে  
 আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে  
 আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-  
 তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের
স্পন্দন-  
 নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,  
 শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে  
 সোনার ডিমের মতো  
 ফাল্গুনের চাঁদ।  
 হয়তো গুলির শব্দঃ  
 আমাদের তির্যক গতিস্রোত,  
 আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,  
 আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!  
 হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ  
 আমাদের স্তব্ধতা,  
 আমাদের শান্তি।  
 আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:  
 থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও
অন্ধকার;  
 আমি যদি বনহংস হতাম,  
 বনহংসী হতে যদি তুমি;  
 কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে  
 ধানক্ষেতের কাছে। 
  
          ====== 

জীবনানন্দ দাশের কবিতা 


     এইসব ভালো লাগে 
জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে  
 আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল
–  
 এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি
ভুল  
 পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,  
 পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে  
 ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসেভিজে জামরুল,  
 নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –  
 পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে  
 কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;  
 তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে  
 মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;  
 তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;  
 পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;  
 কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।  
 নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো  
 কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’ 
  
          ====== 

        একদিন খুঁজেছিনু যারে
একদিন খুঁজেছিনু যারে  
 বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,  
 মালতীলতার বনে, কদমের তলে,  
 নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে!  
 -যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতেরভোরে  
 হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুজিয়াছিনু ঝরঝর  
 কামিনীর ব্যথার শিয়রে  
 যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনাতাতারের দলে,  
 আর্ত কোলাহলে  
 তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়-  
 আজ মনে হয়  

 পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা@  

 -শুধু শেষ নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা  
 শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা  
 দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!  
 মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর  
 শোনে নাই কেউ  
 গাগরীর কোলে তার উত্থলিয়া ওঠে নাই আমাদের  
 গাঙিনীর ঢেউ!  
 নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথের চুপে চুপে  
 ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!  
 মনে হয় শুধু আমি, আর শুধু তুমি  
 আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা  
 রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে কানে কত কাল  
 কহিয়াছি আধো আধো কথা!  
 আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!  
 পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া  
 একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি!  
 এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি  
 আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ!  
 মাহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ  
 জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি  
 দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যেভরি!  
 মসজেদ-সরাই-শরাব  
 ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলেজার তাপ!  
 দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ-আলেয়ার শিখা!  
 পদে পদে নাচে ফণা,  
 পথে পথে কালো যবণিকা!  
 কাতর ক্রন্দন,-  
 কামনার কবর-বন্ধন!  
 কাফনের অভিযান, অঙ্গার সমাধি!  
 মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!  
 মর্মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন-  
 আধো আঁধারের দেশে  
 বারবার আসে ভেসে  
 কার সুর!-  
 কোন্ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরেডাকিনীর মতো  
 মোর কেঁদে মরে মন
  
             ====== 

Jibanananda Das Er Kobita - জীবনান্দন দাশের কবিতা সমগ্র
      কয়েকটি লাইন 
কেউ যাহা জানে নাই কোনো একবানী –  
 আমি বহে আনি;  
 একদিন শুনেছ যে সুর –  
 ফুরায়েছে পুরনো তা — কোনো এক নতুন কিছুর  
 আছে প্রয়োজন,  
 তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন  
 আর নাই কেউ!  
 সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ  
 আজিকার: শেষ মুহুর্তের  
 আমি এক — সকলের পায়ের শব্দের  
 সুর গেছে অন্ধকারে থেমে;  
 তারপর আসিয়াছি নেমে  
 আমি;  
 আমার পায়ের শব্দ শোনো –  
 নতুন এ, আর সব হারানো — পুরনো।  
 উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,  
 পড়ি নাকো দুর্দশার গান,  
 কে কবির প্রাণ  
 উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে –  
 সেই কবি — সেও যাবে সরে;  
 যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ  
 শুধু জেনেছে বিষাদ,  
 মাটির আর রক্তের কর্কশ স্বাদ,  
 যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে  
 যে বকেছে — সেও যাবে সরে;  
 একে একে সবই  
 ডুবে যাবে — উৎসবের কবি,  
 তবু বলিতে কি পারো  
 যাতনা পাবে না কেউ আরো?  
 যেইদিন তুমি যাবে চ’লে  
 পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?  
 কিংবা যদি গায় — পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে  
 একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?  
 আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার  
 সেদিনের পুরানো আঘাত  
 ভুলিবে সে? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি — দিন  
 তাহাদের আর্ত ডান হাত  
 ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ;  
 সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ  
 ভুল মনে হবে;  
 সৃষ্টির বুকের পরে ব্যথা লেগে রবে,  
 শয়তানের সুন্দর কপালে  
 পাপের ছাপের মতো সেইদিনও! –  
 মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,  
 রোগা পায়ে করে পাইচারি,  
 দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি  
 সৃষ্টির দেয়ালে –  
 আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে?  
 যেই উড়ো উৎসাহেব উৎসবের রব  
 ভেসে আসে — তাই শুনে জাগে নি উৎসব?  
 তবে কেন বিহ্বলের গান  
 গায় তারা! — বলে কেন, আমাদের প্রাণ  
 পথের আহত  
 মাছিদের মতো!  
 উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,  
 পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান;  
 শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান –  
 তাই আসি,  
 নানা কাজ তার  
 আমরা মিটায়ে যাই –  
 জাগিবার কাল আছে — দরকার আছে ঘুমাবার;  
 এই সচ্ছলতা  
 আমাদের;আকাশ কহিছে কোন্ কথা  
 নক্ষত্রের কানে?  
 আনন্দের? দুর্দশার? পড়ি নাকো। সৃষ্টির আহ্বানে  
 আসিয়াছি।  
 সময়সিন্ধুর মতো:  
 তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে, জানি, রয়েছ তাকায়ে,  

 ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে  
 ঘুম ভেঙে যায় বার বার  
 তোমার — আমার!  
 জানি না তো কোন্ কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে,  
 ওপারের থেকে;  
 সমুদ্রের কানে  
 কোন্ কথা কই আমি এই পারে — সে কি কিছু জানে?  
 আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে,  
 ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে  
 ঘুম ভেঙে যায় বার বার  
 তোমার আমার!  
 কোথাও রয়েছ, জানি, তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;  
 পথ চলি — ঢেউ ভেজে পায়ে;  
 রাতের বাতাস ভেসে আসে,  
 আকাশে আকাশে  
 নক্ষত্রের পরে  
 এই হাওয়া যেন হা হা করে!  
 হু হু করে ওঠে অন্ধকার!  
 কোন্ রাত্রি — আঁধারের পার  
 আজ সে খুঁজিছে!  
 কত রাত ঝরে গেছে — নিচে — তারও নিচে  
 কোন্ রাত — কোন্ অন্ধকার  
 একবার এসেছিল — আসিবে না আর।  
 তুমি এই রাতের বাতাস,  
 বাতাসের সিন্ধু — ঢেউ,  
 তোমার মতন কেউ  
 নাই আর!  
 অন্ধকার — নিঃসাড়তার  
 মাঝখানে  
 তুমি আনো প্রাণে  
 সমুদ্রের ভাষা  
 রুধিবে পিপাসা  
 যেতেছে জাগায়ে  
 ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে  
 ঝরিতেছ জলের মতন –  
 রাতের বাতাস তুমি — বাতাসে সিন্ধু — ঢেউ,  
 তোমার মতন কেউ  
 নাই আর!  
 গান গায়, যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে,  
 সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,  
 যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে,  
 নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে  
 যেই খানে,  
 পৃথিবীর কানে  
 শস্য গায় গান,  
 সোনার মতন ধান  
 ফ’লে ওঠে যেইখানে –  
 একদিন — হয়তো — কে জানে  
 তুমি আর আমি  
 ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি  
 সেইখানে বর পড়ে!  
 যেখানে সমস্ত রাত্রি রক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে,  
 সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,  
 গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে।  
 ঘুমাতে চাও কি তুমি?  
 অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই? –  
 ঢেউয়ের গানের শব্দ  
 সেখানে ফেনার গন্ধ নাই?  
 কেহ নাই — আঙুলের হাতের পরশ  
 সেইখানে নাই আর –  
 রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস  
 সেইখানে নাই তাহা কিছু;  
 ঢেউয়ের গানের শব্দ  
 যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –  
 ঘুমাতে চাও কি তুমি?  
 সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই!  
 তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন? — নক্ষত্রের তলে  
 অনেক চলার পথ — সমুদ্রের জলে  
 গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর — বাজে –  
 ফুরাবে এ — সব, তবু…. তুমি যেই কাজে  
 ব্যস্ত আজ — ফুরাবে না জানি;  
 একদিন তবু তুমি তোমার আঁচলকানি  
 টেনে লবে; যেটুকু করার ছিল সেইদিন হয়েগেছে শেষ,  
 আমার এ সমুদ্রের দেশ  
 হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেইদিন, — আমার এ নক্ষেত্রের রাত  
 হয়তো সরিয়া গেছে — তবু তুমি আসিবে হঠাৎ  
 গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে,  
 অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!  
 আমার নিকট থেকে  
 তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময়!  
 চাঁদ জেগে রয়  
 তারা ভরা আকাশের তলে,  
 জীবন সবুজ হয়ে ফলে,  
 শিশিরের শব্দে গান গায়  
 অন্ধকার, আবেগ জানায়  
 রাতের বাতাস!  
 মাটি ধুলো কাজ করে — মাঠে মাঠে ঘাস  
 নিবিড় — গভীর হয়ে ফলে!  
 তারা ভরা আকাশের তলে  
 চাঁদ তার আকাঙ্খার স্থল খুঁজে লয় –  
 আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়।  
 একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,  
 ভুলে গেছ আজ তার ভাষা!  
 জানি আমি, তাই  
 আমিও ভুলিয়া যেতে চাই  
 একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা  
 তার স্মৃতি আর তার ভাষা;  
 পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে,  
 একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে  
 যে — মুহুর্তে;  
 একবার হয়ে গেছে, তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে  
 একবার হেঁটেছে যে, তাই যার পায়ে  
 চলিবার শক্তি আর নাই;  
 সব চেয়ে শীত, তৃপ্ত তাই।  
 কেন আমি গান গাই?  
 কেন এই ভাষা  
 বলি আমি! এমন পিপাসা  
 বার বার কেন জাগে!  
 পড়ে আছে যতটা সময়  
 এমনি তো হয়।
  
       ====== 


     দুজন
আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে  
 খুঁজি নাকো; এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলো পৃথিবীর পারে  
 আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,  
 প্রেম ধীরে মুছে যায় নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,  
 হয় নাকি? বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;  
 আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে  
 প্রাণ তার ভরে গেছে।  
 দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে  
 আবার প্রথম এল-মনে হয় যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত
বিশ্বাসে।  
 লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে  
 অন্ধকারে নড়ে চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;  
 তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;  
 যেখানে আকাশে খুব নীরবতা শান্তি খুব আছে,  
 হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ  
 আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের মানুষ  
 আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:  
 সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারি দিকে ঝাউ আম নিম
নাগেশ্বরে  
 হেমন্ত আসিয়া গেছে; চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;  
 ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের সেইআর দেরি,  
 হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;  
 ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের
ফলে।  
 নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায়
ক্ষয়,  
 জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়  
 কী নিয়ে থাকিবে বল; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে
চেতনা,  
 তারপর ঝরে গেছে আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না  
 হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত
বাসনা  
 ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’  
 এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে  
 উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।  
 হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়  
 চারি দিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;  
 চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–  
 প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের
তীরে  
 যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,  
 কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে— বাসনার মতো ভালোবাসা  
 খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’ 
  
             ====== 

 
       পঁচিশ বছর পরে
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠেরউপরে  
 বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়  
 আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–  
 পঁচিশ বছর পরে!’  
 এই বলে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;  
 তারপর কতবার চাঁদ আর তারা,  
 মাঠে মাঠে মরে গেল, ইদুর — পেচাঁরা  
 জোছনায় ধানক্ষেতে খুঁজে  
 এল-গেল। –চোখ বুজে  
 কতবার ডানে আর বায়ে  
 পড়িল ঘুমায়ে  
 কত-কেউ! — রহিলাম জেগে  
 আমি একা — নক্ষত্র যে বেগে  
 ছুটিছে আকাশে  
 তার চেয়ে আগে চলে আসে  
 যদিও সময়–  
 পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!–  
 তারপর — একদিন  
 আবার হলদে তৃণ  
 ভরে আছে মাঠে- –  
 পাতায় শুকনো ডাঁটে  
 ভাসিছে কুয়াশা  
 দিকে দিকে, চুড়ায়ের ভাঙা বাসা  
 শিশিরে গিয়েছে ভিজে — পথের উপর  
 পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়!  
 শসাফুল — দু-একটা নষ্ট শাদা শসা  
 মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা  
 লতায় — পাতায়;  
 ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়;  
 দেখা যায় কয়েকটা তারা  
 হিম আকাশের গায় — ইদুর পেঁচারা  
 ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,  
 পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!
  
====== 

       

Share This Article