রূপকথার গল্প (Rupkothar Golpo) Bengali Fairy Tales

Bongconnection Original Published
22 Min Read


 রূপকথার গল্প (Rupkothar Golpo) Bengali Fairy Tales 

রূপকথার গল্প (Rupkothar Golpo) Bengali Fairy Tales
Loading...


রূপকথার দেশে 
মেঘরাজ্যের সীমানায় এসে চিন্তায় পড়ে গেলো অচিনপুরের রাজপুত্র রঞ্জনকুমার।
বজ্ঞে বুড়ো তো পরিস্কার বলেছিলো যে রাজকন্যা বীরবালাকে নিয়ে দুষ্টু
খোক্কসটা মেঘরাজ্যের ওপারেই গা-ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু মেঘরাজ্যের সীমানা
প্রায় শেষ হতে চললো, এখনো পর্যন্ত খোক্কস তো দূরের কথা, একটা শুঁয়োপোকার
অবধি দেখা মিললো না। কী করবে, কী করবে ভাবতে ভাবতে রঞ্জনকুমার গিয়ে পৌছোলো
মেঘশিশুদের খেলার মাঠে। সেখানে ছোট-বড়ো, সোনালী, সাদা, কালো নানান রকমের
মেঘেদের ছানারা খেলাধূলো করছিলো। এক গালফুলো কালো মেঘের খোকা কে সে শুধোলো,
“ বলি ও মেঘের পো, রাজকন্যা বীরবালা কে দেখেছ নাকি এখানে ? দুষ্টু খোক্কস
তাকে ধরে নিয়ে এসেছে ? দেখেছ কী তাকে ?”
মেঘের খোকা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“আমি জানিনে, আলো পরীদের শুধিয়ে দেখতে পারো। তারা সুয্যি মামার সাথে সাথে পুরো
দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় কিনা, তারাই জানবে।“
“ তা, আলো পরীদের দেখা পাবো কোথায় বলো তো ?”
মেঘের খোকা তো হেসেই অস্থির,
“ এমা, তাও জানো না…. সেই যেখানে রামধনু তৈরী হয়, আলো পরীরা বৃষ্টি ফোঁটার
প্রিজমে সাদা আলোর বাঁধন খুলে সাতরঙা আলোর সুতো তৈরী করে আর তারপর রামধনু বোনে
একটু একটু করে। ওখানে যাও বরং, আলো পরীদের সব্বাই কে পেয়ে যাবে।“
রঞ্জনকুমার ভারী লজ্জা পেয়ে একটুখানি মাথা চুলকে বললো,
“ মানে বলছিলাম কী, ওই যে কী বলে রামধনুর কারখানা কোথায় তা আমি জানি নে, যদি
তুমি একটু বাতলে দিতে পারো …”
মেঘের খোকা কোমরে হাত দিয়ে, রেগে গিয়ে বললো,
“ অ্যাইয়ো, তুমি সত্যি সত্যি রাজকুমার তো, আমার কিন্তু বাপু একটুও বিশ্বাস হচ্ছে
না!”
“ কেন, কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না কেন ?”


“ রূপকথার সব গল্পে তো পড়েছি যে রাজপুত্তুর সবসময় সব কিছু জানে, তাদের খিদে
নেই, তেষ্টা নেই, বুকে ভয় বলে কিচ্ছুটি নেই, তাদের কাতুকুতু লাগে না, কান্না
পায় না হ্যানত্যান আরোও কত কিছু‌ । তা তোমাকে দেখে তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না।
রামধনুর কারখানা কোথায় তাও জানো না, কেমনধারা রাজপুত্তুর তুমি !”

সেরা রূপকথার গল্প

Loading...
রঞ্জনকুমার ভারী চিন্তায় পড়ে গেলো, মেঘের খোকা কে বোঝাবে কী করে যে পুরোনো
রূপকথার গল্পে যতকিছু লেখা ছিলো, তার আদ্ধেক হলো গিয়ে ছেলেভোলানো বাজে কথা।
ওগুলো বিশ্বাস করতে নেই মোটেই। তার ওপরে এই খোকাটা ভীষণ পাকা, সত্যি কথা শুনলেও
বিশ্বাস করবে না। তাই সে বুদ্ধি করে বললো,
“ তাই যদি বলো তো , রূপকথার গল্পে তো কোথ্থাও লেখা নেই যে মেঘেদের ছানারাও কথা
বলতে পারে, হাসতে পারে, কাঁদতে পারে। সেখানে তো শুধুই লেখা যে মেঘের দল গুরগুর
করে, আর বৃষ্টি হয়ে সবকিছু জলে ভিজিয়ে দেয়।“
খোকা মেঘ তো রেগেই আগুন,
“ ওমা, ওসব আবার কেমনধারা কথা, দুগ্গাপুজোর সময় দেখনি বুঝি সারা আকাশ জুড়ে কেমন
হেসে উঠি আমরা। তারপর মনে করো বৃষ্টি হওয়ার আগে সবাই মিলে সাবধান করি তোমাদের,
ওগো কে কোথায় আছো, ঘরে ফেরো গো, ঘরে ফেরো তাড়াতাড়ি! আকাশ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি
নিয়ে এসেছি আমরা…তা বাপু সেসব হাঁকডাক শুনে তোমরা যদি বলো যে আমরা গুরগুর
করছি, তাতে আমাদের কী দোষ !”
“তাহলে, এবার বুঝলে তো, রূপকথার গল্পে যা লেখা থাকে তার সবকিছুই সত্যি হয় না। “
মেঘের খোকা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ালো এবার, তারপর বললো,
“ আচ্ছা চলো তোমায় দেখিয়ে দিই রামধনুর কারখানা কোথায় ।”
এরপর মেঘের খোকার দেখানো পথ ধরে রঞ্জনকুমার সোজা পৌছে গেল রামধনুর কারখানায়।
আলোর পরীরা মিষ্টি রিনরিনে সুরে গান গাইতে গাইতে রামধনু বুনছিলো সেখানে।
রাজকুমারকে দেখে পরী রানী লিং-টিং উড়ে এলেন তাড়াতাড়ি,
“ কে, কে ওখানে ? কী চাও তুমি ?”
রঞ্জনকুমার একটু ভয়ে ভয়ে বললো,
“ পেন্নাম হই পরী রানী, আমি রাজপুত্র রঞ্জনকুমার।“
রঞ্জনকুমার তাকে পেন্নাম করলো, এত সম্মান দিয়ে কথা বললো, এসব দেখে লিং-টিং ভারী
খুশি হলেন। বড়োদের সম্মান দিয়ে কথা বলে যারা তারা ভালো ঘরের ছেলেমেয়ে, একথা কে
না জানে ! কাজেই লিং-টিং হাসিমুখে একটুকরো রামধনু পেতে দিয়ে বললেন,
“ এসো এসো রাজকুমার, রামধনুর আসনে বসো।“
অন্যান্য পরীরা ছুটোছুটি করে টিউলিপ ফুলের পেয়ালায় ভরে কমলা লেবুর রস নিয়ে এলো
অতিথির জন্য। সেই রস খেয়ে তেষ্টা মিটলো রাজকুমারের। তারপর সে বললো,
“ পরী রানী, রূপকথার দেশের রাজকন্যা বীরবালাকে ধরে নিয়ে গেছে দুষ্টু খোক্কস।
তাকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই এসেছি আমি।“
লিং-টিং ভারী অবাক হলেন সে কথা শুনে। তিনি বললেন,
“ খোক্কসটার মাথায় একটু বুদ্ধিসুদ্ধি কম আছে।মাঝে মাঝে বোকার মতো কাজকর্ম করে
ফেলে সেকথা আমিও জানি। কিন্তু এত দুষ্টু তো সে নয় যে মিছিমিছি একটা রাজকন্যে কে
চুরি করে পালাবে। হুমমম্, আমার মনে হয় কোথাও একটা গন্ডগোল হচ্ছে।“


“গন্ডগোলের কী আছে এতে। রাক্ষস-খোক্কসগুলো দুষ্টুমি করে রূপকথার দেশের
রাজকুমারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে রাক্ষসপুরী তে আটকে রাখবে,পরে রাজকুমারের কাছে বেদম
পিটুনি খেয়ে হাউ-মাউ-খাঁউ বলে দৌড়ে পালাবে। তারপর রাজামশাই আদ্ধেক রাজত্বসহ
রাজকন্যাকে তুলে দেবেন রাজকুমারের হাতে….এমনটা তো আকছারই হচ্ছে। এতে অবাক
হওয়ার কী আছে ?”
লিং-টিং হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন প্রায়,
“কোন মান্ধাতা আমলের পুরানো রূপকথার গল্প শোনাচ্ছো রঞ্জনকুমার? বলি রাজকন্যের কী
নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি ! যাকে তাকে অমনি দিয়ে দিলেই হলো। একি
মোহরের থলে নাকি ? আর তাছাড়া বুদ্ধিসুদ্ধি কম থাকে বলে রাক্ষস-খোক্কসগুলো
পড়াশোনা তেমন কিছু করতে পারে না এমনিতেই। তার ওপরে মানুষের ভয়ে আজকাল বন-জঙ্গল
থেকেও বেড়োতে ভয় পায়। তাই একথা বিশ্বাস করা একটু শক্তই বটে যে খোক্কস বেচারা
অমনি অমনি কথা নেই বার্তা নেই বীরবালাকে চুরি করে নিয়ে পালাবে। তুমি নিজেই ভেবে
দেখো।“

রূপকথার রাজকন্যার গল্প

রঞ্জনকুমার চোখ বন্ধ করে ভাবলো ব্যাপারখানা। পরী রানীর কথা তো ভুল নয়। প্রথম কথা
হলো মহারাজ বীরবাহুর কন্যা রাজকুমারী বীরবালা যথেষ্ট সাহসী, অন্যান্য ন্যাকা
রাজকন্যেদের মতো গয়না-শাড়ি-ফুল-প্রজাপ্রতি নিয়ে অনর্থক আদিখ্যেতা করে মিছিমিছি
সময় নষ্ট না সে। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই রাজনীতি, শস্ত্রবিদ্যা, অর্থনীতি সবকিছু
শিখে নিজেকে রাজ্য শাসনের উপযুক্ত করে তুলেছে। সত্যিকথা বলতে কী রাজকন্যা
বীরবালার সঙ্গে যখন বিয়ের প্রস্তাব এলো, তখন রঞ্জনকুমার ভয় পেয়ে “না” বলে
দিয়েছিলো। আর ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক, বীরবালা যেমন সুন্দর, সুশিক্ষিতা তেমনি
তরোয়াল চালাতেও ওস্তাদ। তাকে বিয়ে করা যে সে মানুষের কর্ম নয়। কিন্তু পরে পিতা
মেরুসিংহ-র কথায় বুক দুরুদুরু করা স্বত্তেও সে রাজি হয়েছিলো, কেননা রূপকথার
দেশের রাজকন্যা আবার আদ্ধেকখানা দেশ পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়।
তারপর মেরুসিংহ আবার বোঝালেন যে বীরবালা যত বড়ো যোদ্ধাই হোক না কেন, বিয়ের পর
তিনি যখন অচিনপুরের রানী হয়ে যাবেন তখন তো আর তাকে যুদ্ধ করতে হবে না।
রাজপ্রাসাদের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের মতো তিনিও থাকবেন অন্ত:পুরে। কাজেই যুদ্ধের
কলাকৌশল ভুলে যেতে তার সময় লাগবে না বেশী। আর বিয়ের যৌতুক হিসেবে রঞ্জনকুমার
এমনিতেই আদ্ধেকখানা রূপকথার দেশ পাচ্ছে, আর পরে রাজা বীরবাহুর অবর্তমানে পুরো
দেশেরই অধীশ্বর হয়ে বসবে সে। কাজেই বীরবালার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে
দেওয়াই ভালো।
এদিকে রাজা হয়ে রাজ্যশাসন করার ইচ্ছে রঞ্জনকুমারের কোনো কালেই ছিলো না। সে
বেচারা কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে বড়ো ভালোবাসে। কিন্তু পিতা মেরুসিংহকে সে কথা
জানাতে ভয় পায়। বীরবালা কে বিয়ে করার ব্যাপারেও দুমনা হয়ে শেষমেশ পিতার ভয়েই
হ্যাঁ করেছিলো। এরপরই হলো এই বিপদ। এক সপ্তাহ পরে খবর এলো যে, এক দুষ্টু খোক্কস
এসে নাকি রাজকন্যে কে ধরে নিয়ে গেছে। কাজেই কী আর করা, খুব বেশী ইচ্ছে না থাকলেও
রঞ্জনকুমার কে বেড়োতে হলে রাজকুমারী কে উদ্ধার করার জন্যে। নইলে মহারাজ
মেরুসিংহের নাক কাটা যাবে যে ? লোকে কী বলবে !
মুখখানা ব্যাজার করে রঞ্জনকুমার বসে বসে ভাবছিলো এসব কথা। কী দরকার ছিলো বিয়ের
জন্য “হ্যাঁ” বলার। “না” বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। এখন কী বিপদ বলো দিকিনি
!রঞ্জনকুমার না পারে এগিয়ে যেতে, না পারবে পিছিয়ে আসতে।
ওদিকে রাজকুমার কে চুপ করে বোকার মতো বসে থাকতে দেখে পরী রানী লিং-টিং বললেন,

“ কুমার,তুমি যদি চাও তো সবকিছু খুলে বলতে পারো আমায়। কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল
হচ্ছে। রাজকুমারী বীরবালার নাম আমিও শুনেছি। অমন একখানা বোকাসোকা খোক্কস এসে
অমনি অমনি এক যোদ্ধা রাজকন্যা কে তুলে নিয়ে গেল, একথা বিশ্বাস করা ভারী শক্ত।“
অগত্যা আর কোনো উপায় না দেখে লিং-টিং কে সবকিছু খুলে বললো রঞ্জনকুমার। কারোর
সাহায্য তো নিতে হবেই তাকে। পরী রানী লিং-টিং অবশ্য কথা রাখলেন। সবকিছু শোনার
পর তিনি বললেন,
“ ভয় পেয়ো না কুমার। চলো চাঁদবুড়ির কাছে যাই।“
রাজকুমার বললে,
“ চাঁদবুড়ি কে ?”
“ ওই যে চাঁদে বসে চরকা কাটে যে বুড়ি। পেঁজা তুলোর মতো জ্যোৎস্না চড়কায় ফেলে
ঝলমলে আলোর সুতো তৈরী করে। হাওয়ার মতো হালকা, মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা, আর
রেশমের থেকেও নরম তেমন সুতো কেউ কোথ্থাও দেখেনি। তারপর সেই সুতো দিয়ে
চাঁদবুড়ি অ্যাই অ্যাত্তো বড়ো বড়ো দুটো রুমাল তৈরী করে প্রতিদিন। রুমাল তৈরী
শেষ হলে, সেই রুমাল দুটো দিয়ে রাত্রিবেলা সুয্যি কে আর দিনের বেলা চাঁদটাকে
বেশ ঝেড়ে-মুছে চকচকে করে রাখে সে। সে জন্যই তো চাঁদ-সুয্যি দুটোই অমন ঝলমল করে
সবসময়। বুড়ি ভীষণ ব্যস্ত থাকে, সময়মতো চাঁদ-সুয্যিটাকে ঝেড়ে মুছে আকাশের
গায়ে টাঙিয়ে দিলে তবেই না দিন-রাত্রি হবে।“
সবকিছু শুনে রাজকুমার বললো,
“ সেসব তো বুঝলাম পরী রানী। কিন্তু চাঁদবুড়ি-র সাথে খোক্কসের সম্পর্ক কী ?”
“ ওমা, বলিনি বুঝি! খোক্কসটার কিনা ছোটোবেলা থেকেই মা-বাবা কেউ ছিলো না তাই
চাঁদ বুড়ি পুষ্যি নিয়েছিলো তাকে। এখন বড় হয়ে গিয়েছে বলে খোক্কস কাঁচ
পাহাড়ে তার নিজের বাড়িতে থাকে। কিন্তু সে বাড়ির চাবি রয়েছে চাঁদবুড়ির
আঁচলে বাঁধা। কিন্তু সাবধান, চাঁদবুড়ি বড়ো সেয়ানা, সে নিজের থেকে না দিলে ওই
চাবি নেওয়ার সাধ্য নেই কারুর, বুঝলে !”
“বুঝলাম। “
অতএব পরী রানী লিং-টিং আর রঞ্জনকুমার দুজনে মিলে চললো চাঁদবুড়ির কাছে। সে
বুড়ি তো কিছুতেই দেখা করবে না তাদের সাথে। চরকা ঘাড়ে তুলে খালি সে এদিক ওদিক
পালানোর চেষ্টা করে।পরী রানী অনেক বলে কয়ে, হাতে-পায়ে ধরে রাজি করালো বুড়ি
কে একটি বার কথা বলার জন্য। পরী রানীর কাকুতি-মিনতি শুনে আর রাজকুমারের করুণ
মুখখানা দেখে বুড়ি চাঁদের মাটির উপর থেবড়ে বসলো আর চরকা চালালো গুরুর-গুরুর-
গুরুর-গুরুর….
রাজকুমার আর পরী রানীর কাছে সবকিছু শোনার পর বুড়ি খোক্কসের ওপরে ভারী রেগে
গিয়ে বললো,
“ ভালো রে ভালো, রাজার পো, বেশ করেছো আমার কাছে এয়েছো তোমরা। খোক্কসটা যে এমন
দুষ্টু হয়েছে তা তো বাপু আমার জানা ছিলো না। এ আবার কী কথা,
আলু-পটল-চাল-সুপুড়ি হলে বুঝতুম, সোনা-রুপো-হীরে-মাণিক তাও না হয় বুঝি। কিন্তু
এ আবার কী, রাজকন্যে আবার কেউ চুরি করে নাকী!”
ভীষণ রেগে গিয়ে চাঁদবুড়ি, পরী রানী আর রাজকুমার কে নিয়ে রওনা দিলো খোক্কসের
বাড়ি। কাঁচের পাহাড়ের উপরে সেই বাড়ি। পরী রানী লিং-টিং না হয় উড়ে উড়ে
ওপরে উঠে যাবেন কিন্তু বাকী দুজনের কী হবে? চাঁদবুড়ি আর রাজকুমার তো উড়তে
জানে না। “হায় হায়” করে উঠলো রঞ্জনকুমার।এতদূর এসে সবকিছু পন্ড হলো বুঝি।
কিন্তু চাঁদবুড়ি তার ফোকলা মুখে ভারী মিষ্টি হেসে বললো,
“ ভয় পাসনি রাজার পো, তোর ঠাকমা থাকতি ভয় কিসের ?”
এই বলে চাঁদবুড়ি তার আঁচলের খুটে বেঁধে রাখা একটুকরো আলোর সুতো বের করলো।“
রঞ্জনকুমার আর পরী রানী অবাক হয়ে গেলেন,
“ ও ঠাকমা, ওইটুকুনি সুতো দিয়ে কী হবে !”
চাঁদবুড়ি আবার হাসলো,
“ হবে হবে রাজার পো, এতেই হবে। একী আর যেমন তেমন সুতো রে দাদুভাই! সোনার মতো
জোৎস্না সাঁচা, শ্বেতপদ্মের শিশিরে মাজা এই মায়াসুতোর মতো শক্ত যে আর কিচ্ছুটি
নেই রে ভাই। সৎ কারণে, ভালো লোকের হাতে পড়লে এই সুতো দিয়ে যে এক পৃথিবী
লোককেও বেঁধে রাখা যায় একসাথে। কিন্তু খবরদার, মন্দ লোকের হাতে গেলে হবে
সর্বনাশ! তাইতো এমনি আঁচলে বেঁধে রাখি রে সবসময়।“
তারপর চাঁদবুড়ি পরী রানীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“ ও মেয়ে, আর দেরী করোনি, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে আমার ওদিকে। চটপট যাও দিকিনি
উড়ে ওই পাহাড় চূড়োয়। এই সুতোটা রাখো সঙ্গে, চূড়োয় আছে সোনার বট, বাঁধবে
সুতো তার অঙ্গে….”
চাঁদবুড়ির কথা মতো পরী রানী লিং-টিং পাহাড় চূড়োয় উঠে সোনার বটের গোড়ায়
সেই মায়াসুতো বেঁধে দিলেন। তারপর সেই সুতো ধরে টানতেই, ওমা কী আশ্চর্য্য, সেই
সুতো এই বাড়ে তো সেই বাড়ে। বাড়তে বাড়তে সুতো গিয়ে পড়লো কাঁচ পাহাড়ের
নীচে চাঁদবুড়ির হাতে। তারপর চাঁদবুড়ি আর রাজকুমার সেই সুতো ধরে ধরে উঠে এলো
পাহাড় চূড়োয়, খোক্কসের বাড়ির দরজায়। কিন্তু চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়ির
ভেতরে ঢুকে সবার চক্ষু ছানাবড়া। ঘরের মধ্যে কেউ কোথ্থাও নেই। খালি কার্পেটের
ওপর পড়ে আছে রাজকন্যা বীরবালার তরবারি আর একটা শ্লেট-পেনসিল্। তাতে বড়ো বড়ো
করে আঁকা-বাঁকা হরফে লেখা “অ, আ,ক,খ…।“
কোথায় গেলো বীরবালা ? দুষ্টু খোক্কস তাকে খেয়ে ফেললো নাকী! কি সব্বোনাশ !
কিন্তু সে কথা শুনে চাঁদবুড়ি বললো,
“সে কী করে হয়, খোক্কস তো ভারী ভালোমানুষ, সেতো খালি ফলপাকুড় আর চা-বিস্কুট
খায়। বীরবালা কে খাবে কেন ?”

রাজকন্যা ও রাজপুত্রের গল্প

তাও বটে, ঠিক কথা, ঠিক কথা! তবে খোক্কস ব্যাটা গেলো কোথায় ! আর সবথেকে বড়ো
আশ্চয্যি হলো যে বীরবালার কাছে যদি তরোয়ালই ছিলো তো খোক্কস তাকে ধরে বেঁধে
আনলো কী করে ?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তারা শুনলো খোক্কসের বাড়ির পেছন দিকের ছোট্টো
পুকুরটাতে শব্দ হচ্ছে
“ ঝুপ-ঝুপ-ঝুপ্পুস!”
আর অমনি তার সঙ্গে মিষ্টি মেয়েলি গলায় খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ। একটু পরে তার
সাথে যোগ হলো ঘোয়া-ঘোয়া-ঘুঙ-ঘুঙ করে আজব আরেক শব্দ, হাসির না কান্নার বলা
মুশকিল !
রঞ্জনকুমার, চাঁদবুড়ি আর পরী রানী লিং-টিং সেই শব্দ শুনে পড়িমড়ি ছুটে গেলেন
পুকুর ধারে। তারা গিয়ে দেখেন খোক্কস বেচারা একখানা ছিপ হাতে পুকুরের পাশে
কাদায় পড়ে গড়াচ্ছে আর তারই একটু দূরে একখানা ছোট্টো ঝুড়িতে দু-চারখানা মাছ
নিয়ে হেসে কুটোপাটি হচ্ছে রাজকন্যে বীরবালা।
এরা তিনজন তো এক্কেবারে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
এটা কী হলো! রাজকন্যে আর খোক্কস এমনি করে হাসছে একসাথে !
ওদিকে হলো কী আমাদের খোক্কস ছিলো ভারী লাজুক‌। রঞ্জনকুমার, চাঁদবুড়ি আর পরী
রানী লিং-টিংকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বেচারা ভারী লজ্জাটজ্জা পেয়ে
গিয়ে লুকোলো পুকুরের জলে। কিন্তু অতটুকু ছোট্ট পুকুরে কী আর ওই অ্যাত্তোবড়ো
খোক্কস আঁটে, তোমরাই বলো ? তাই খোক্কসের মুখটুকুই রইলো জলের নীচে, বাকী
শরীরটুকু বিশেষ করে খুদে ন্যাজখানা রয়ে গেলো জলের উপরে….উঁচু হয়ে ।

সে দেখে আবার সব্বাই হেসে উঠলো হো হো করে। তারপর রঞ্জনকুমার দৌড়ে গেল বীরবালার
কাছে,
“ বীরবালা তুমি ভালো আছো তো?”

বীরবালা বললো,
“ ভালো থাকবো না কেন, খুব ভালো আছি।“

“ তবে যে রাজা বীরবাহু বললেন, তোমাকে খোক্কস ধরে নিয়ে গেছে! কিন্তু তুমি তো
এখানে….”
“ বীরবালার তরোয়ালের সামনে দাঁড়াতে রূপকথার দেশের সেরা যোদ্ধারও বুক কেঁপে
ওঠে, তোমার মনে হয় ওই বেচারা খোক্কস আমাকে ধরে আনতে পারবে ?”

“তবে!”
“ আমি সেচ্ছায় সে দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছি। প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে, জঙ্গলে
ঢুকে দেখি খোক্কস লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে খিদে পেয়েছে বলে। সেখান থেকে তাকে
খাইয়ে দাইয়ে আমি সাথে নিয়ে ঘুরছিলাম। বোধহয় আসার পথে কেউ দেখতে পেয়েছে, আর
তাতেই সবাই জেনেছে যে খোক্কস আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে !”

চাঁদবুড়ি বললো,
“ আমি আগেই জানতুম, আমার খোক্কস খোকা বোকা হতে পারে, কিন্তু
দুষ্টু-পাজি-বদমায়েশ সে কক্ষনো নয়।“
পরী রানী লিং-টিংও বললেন,
“ দেখলে রাজকুমার, আমি বলেছিলাম না কোনো গন্ডগোল হচ্ছে কোথাও।“
তাদের কথা শুনে রঞ্জনকুমার বললো,
“ কিন্তু কেন রাজকন্যা? কেন অমনভাবে পালিয়ে এলে তুমি ? আর কদিন পরে বিয়ে
আমাদের, অচিনগড়ের রাজরানী হতে চলেছ তুমি।“

বীরবালা হেসে বললো,
“ চাইনে হতে আমি রাজরানী। তোমাকে চিনিনে জানিনে বিয়ে করবো কেন ? আর তুমিই বা
কী, বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললে কেন ?”
“না মানে, বাবা বললেন….”
“ কী বললেন, রাজকন্যের সাথে অর্ধেক রাজত্ব পাচ্ছো, বিয়ে করে নাও! আর তুমিও
অমনি রাজি হয়ে গেলে। তুমি বোঝাতে পারলে না তোমার বাবা কে? কেমন রাজকুমার
তুমি!”
“ কিন্তু রাজকন্যা, এতে অন্যায় কী ?”
“ অন্যায় নেই মানে! যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা অন্যায় নয়? রূপকথার দেশ শাসনে
সম্পূর্ণ সক্ষম আমি কেন তোমার রাজপুরী তে গিয়ে ন্যাকা সুয়োরানি সেজে বসে
থাকবো ? আর যে তুমি তরবারি ঠিক করে ধরতে অবধি পারো না, সে হবে আমার দেশের
রাজা!পালিয়েছি বেশ করেছি!”
“ আমি যোদ্ধা নই রাজকন্যা, আমি শিল্পী। এই কী আমার দোষ!”
“ সে কথা নিজের বাবাকে গিয়ে বলো। তুমি শিল্পী তা তোমার দোষ নয়, কিন্তু
শিল্পীর তুলি দিয়ে রাজ্যশাসন করা যায় না কুমার। সেজন্য শস্ত্রবিদ্যা, রণনীতি,
কুটনীতির জ্ঞান প্রয়োজন। যদি সত্যি শিল্পী হয়ে থাকো, তবে সত্যিটুকু বলতে
শেখো। মিথ্যে দিয়ে কোনো শিল্প হয় না।“
“ তাহলে তুমি বিয়েও করতে চাও না !”
“ হয়তো সময়মতো করবো, কিন্তু এখন কখনোই নয়। আমি রাজ্য শাসন করতে চাই, পুরো
পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই, আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হতে চাই, তারপরে অন্য কিছু নিয়ে
ভাববো।“
রাজকন্যার কথা শুনে রঞ্জনকুমারের যারপরনাই ভালো লেগেছিলো। সত্যিই তো, একটাও কথা
তো ভুল বলেনি বীরবালা। যে মানুষ যে কাজে ভালো, তার তো সেই কাজেই এগিয়ে যাওয়া
উচিত। কেউই কারোর মতো হয় না, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে একজন ভালো আর
আরেকজন খারাপ। প্রতিটা মানুষ নিজের নিজের মতো করো ভালো।
রঞ্জনকুমার একটু ভেবে বললো,
“ রাজ্য শাসন করো, পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখো, শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হও, কিন্তু তার সাথে
আরেকখানা জিনিস দেব, নেবে বীরবালা?”
“কী?”
“ অচিনপুরের রাজমুকুট ও রাজদন্ড!”
“মানে ?”
“ ভেবে দেখলাম, তোমার মতো শাসনক্ষমতা আমার কক্ষনো হবে না, আর আমি চাইও না শাসন
করতে বা যুদ্ধে যেতে। আমি শিশুদের জন্য পাঠশালা বানাতে চাই বীরবালা,
স্থাপত্যে-ভাস্কর্যে ভরিয়ে তুলতে চাই পুরো অচিনপুর। যাতে কোনো শিশুর ওপর কখনো
অশিক্ষার ছায়া না পড়ে। যাতে শুধু যোদ্ধা বলেই নয়, প্রতিটি রাজ্যবাসী নিজের
গুণের উপযুক্ত সমাদর পায় সমাজে…. তাই বলছি বিয়ে করো বা নাই করো, রূপকথার
দেশের সাথে অচিনপুরেরও শাসন দায়িত্বও নাও তুমি। তার পরিবর্তে এই দুই রাজ্যের
শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির দায়িত্ব নিচ্ছি আমি।“
বীরবালা বহু সময় ধরে ভাবলো। আগে যতই রাগ থাকুক না কেন, রাজপুত্র তার জন্য
সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে, নিজের প্রাণ হাতে করে এত দূরে এসেছে। সে শিল্পী,
যুদ্ধ জানে না। পথে হাজারখানা বিপদ হতে পারতো, কিন্তু সেসব কিছু কে ভয় পেলেও
নিজের ভয় কে জয় করে রঞ্জনকুমার এতদূর এসেছে। বীরবালা নিজে যোদ্ধা বলেই খুব
ভালো করে জানতো যে শত্রুকে জয় করার থেকেও লক্ষ্যগুণ কঠিন হলো নিজের ভয় কে
যুদ্ধে হারানো। রঞ্জনকুমার তো সেই ভয়কেই জয় করে ফেলেছে, তবে সেই বা যোদ্ধার
থেকে কম হলো কীসে ?

রঞ্জনকুমার আবার প্রশ্ন করলো,

“ বলো বীরবালা, তুমি রাজি ?”
বীরবালা মিষ্টি হেসে বললো,

“ রাজি, রূপকথার দেশের সাথে অচিনপুরেরও দায়িত্ব নেবো, তবে শুধু শাসিকা
হয়ে
নয়, নেবো তোমার রানী হয়ে।“
তারপর, তারপর আর কী, শুভদিনে, শুভক্ষণে রাজকন্যা বীরবালার সাথে বিয়ে হলো
রাজপুত্র রঞ্জনকুমারের। বিয়ের দিন দুই রাজ্যের মানুষ পেট পুরে মন্ডা-মেঠাই
খেয়েছিলো। চাঁদবুড়ি এসে উপহার দিয়েছিলো আলোর সুতোয় বোনা আসমানি রঙের শাড়ি,
মেঘের দল নিয়ে এলো প্রতি বর্ষায় বৃষ্টির আশীর্বাদ, আলো পরীদের সঙ্গে নিয়ে
পরী রানী লিং-টিং দুই রাজ্য ভরিয়ে দিয়েছিলেন রামধনু রঙের আলোয়।
আর খোক্কসের কী হলো?
খোক্কস এসে প্রথম প্রথম ভারী লজ্জা পেয়েছিলো বটে, কিন্তু এত আনন্দ,
জাঁকজমক, মন্ডামেঠাই দেখে সে খানিক পরেই লজ্জা টজ্জা সব ভুলে ধিন-তা-ধিনা-ধেই বলে
নাচতে লাগলো। শুনেছি রূপকথার দেশ আর রাজকন্যা বীরবালাকে তার এমন ভালো লেগেছিলো
যে বিয়ে শেষ হলে পাকাপাকি ভাবে সে রূপকথার দেশেই থেকে গেলো। সব বাচ্চাদের সাথে
মিলেমিশে সেও এখন মন দিয়ে পাঠশালায় “ অ-আ-ক-খ” পড়ে।
কী বললে,একটুও বিশ্বাস হলো না।
বিশ্বাস না হলে আমার কী, রূপকথার দেশের ঠিকানা দিচ্ছি, যাও বাপু নিজের চোখেই
গিয়ে দেখে এসো …
—সমাপ্ত-
প্রিয় গল্প পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট। ভালো থাকুন।.. Thank
You, Visit Again…


Share This Article