হৃদয় ছোঁয়া প্রেমের গল্প – Heart Touching Love Story

Bongconnection Original Published
20 Min Read


 হৃদয় ছোঁয়া প্রেমের গল্প – Heart Touching Love Story 

হৃদয় ছোঁয়া প্রেমের গল্প - Heart Touching Love Story
Loading...

শোধ
                 – সংঘমিত্রা
মন্ডল 
 
“আমি আর পারছিনা! কেন করলি এরকম? প্লিজ কিছু তো বল!” – অফিসের বাথরুমে ফিসফিস
করে বলে ওঠে মেয়েটি। দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বাঁধ মানছে না যেন। ফোনের ওপাশটা
কফিনের মতোই নিস্তব্ধ! এপাশে অপেক্ষায় সময় কাটে। ফোনটাই কেটে গেল একসময়।
অনেকক্ষণ বাদে, ধীর পায়ে বেরিয়ে এল মেয়েটি! বেসিনের পাশে আয়নায় নিজের
প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল। ঝাপসা। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। হয়তো বুক থেকে
কিছুটা তাজা রক্তও বেরিয়ে এসেছিল জলের সাথে। কাজলটা থেবড়ে গিয়ে লেপটে আছে চোখের
তলায়। জলের দাগ মুছে দিয়ে আবার নতুন জলের রেখা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে! একটা টিস্যু
নিয়ে ঘষে ঘষে কাজলের দাগ পরিস্কার করতে থাকে মেয়েটি। বাইরে বেরিয়েই আবার তাকে
হাসিখুশির অভিনয় করতে হবে! কিন্তু, মনের মধ্যে যে ঝড়টা আছড়ে পড়েছে, তার দাপটে
বাইরেটাও নড়ে উঠেছে যে! পারবেতো সামলাতে! ভেঙে পড়ে যদি সবার সামনেই! আরও জোরে
ডলতে থাকে টিস্যু দিয়ে, শুধু কালি নয় স্মৃতিগুলোকেও রগড়ে রগড়ে আবছা করে ফেলতে,
একেবারে মুছে ফেলতে।     
—————————————————————-

শিবশঙ্কর সকাল থেকেই ভারী ব্যস্ত আজ। বাজারেই গেলেন বার তিনেক। এখন আবার
ছুটেছেন মেয়ের জন্য স্পেশাল জলভরা সন্দেশ আনতে। পুনেতে কি আর এসব পাওয়া যাবে!
ভেবেই বুকে যেন হাওয়া কমে আসছে তাঁর। এই সেদিনও মেয়েটা ছোট ছোট পায়ে সারা বাড়ি
ঘুরে বেড়াতো। আধো আধো কথা শুনে হেসে বলতেন পাকা বুড়ি একটা। কবে যে এতোটা বড়ো
হয়ে গেল বুঝতেই পারেন নি তিনি। দিয়া শুধু তাঁর একমাত্র সন্তান না, সমস্ত বুকটাও
জুড়ে আছে সে। সেই দিয়া আজ চাকরির জন্য পুনে চলে যাচ্ছে! এতদিন যেভাবে ওকে আগলে
রেখেছিলেন, এখন এতদূরে চলে গেলে কি যে করবেন ভেবেই কদিন তাঁর ঘুম হয় নি। পাছে
মেয়ের সামনে মনখারাপ করে ফেলেন, আজ সারাদিন তাই নিজেকে অকারণ ব্যস্ততায় ডুবিয়ে
রেখেছেন তিনি!


মাঝে মাঝেই আঁচলে চোখ মুছছেন বনলতা। পেঁয়াজ আর তেলের বড্ড ঝাঁঝ বলেই এমনটা
হচ্ছে! অন্যদিনের মতো দিয়ার বাবা একবারও রান্নাঘরে উঁকি মারেনি চায়ের জন্য আজ।
বাবুর আর সময় হবে কি করে, সকাল থেকেই তো চরকির মতো ছুটছে! শুধু একটা বেগুন আনতে
আধ ঘণ্টা লাগাতে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন বনলতা! মেয়েটা যেন তাঁর একার!
বনলতার দুঃখ হচ্ছে না? তিনি কি তাই বলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নাকি কেঁদে
ভাসাচ্ছেন! চোখটা আর একবার মুছে নিলেন!  শুকনো লঙ্কাগুলো বড্ড বাজে! 
সমস্ত ডকুমেন্টগুলি ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল দিয়া। নতুন জায়গা, নতুন চাকরী। খুব
যে টেনশন হচ্ছে তা না। কলেজের আরও তিনজন বন্ধুরও একই দিনে জয়েনিং। কিন্তু সে তো
বাবা-মাকে ছেড়ে থাকেনি কোথাও এর আগে। কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছে কাল থেকে। অথচ
তাদের দেখো! একজন দুনিয়ার রান্না করছে সকাল থেকে আর একজন রাজ্যের জিনিস এনে
হাজির করছে! মেয়েকে একটু সময় দিতে পারত না এই সব না করে! অভিমানে দিয়াও কথা
বলছে না বেশি।
“দিয়া একবার কথা বল তো!” – শিবশঙ্কর ঘরে ঢুকেই ফোনটা এগিয়ে দিলেন মেয়ের দিকে।
“হ্যালো!” “কে সেটা তো বল?”- ওদিকে থেকে আওয়াজ না পেয়ে বিরক্ত দিয়া।
“সমর দা, কথা বল” – শিবশঙ্কর ঔৎসুক হয়ে কানটা ফোনের কাছে এনে শোনার চেষ্টা
করেন।
“হ্যাঁ কাকু! কেমন আছো!” “আচ্ছা!” “হ্যাঁ, কাল জয়েনিং!” “ও তাই! বাহ!” “আচ্ছা
তুমি বল আমি লিখে নিচ্ছি নম্বরটা।“ “নিশ্চয় জানাবো!” “রাখছি কাকু।“  
ফোন রেখেই রাগের ঝাপটা দিয়ে উঠল দিয়া – “এসব কি বাপি! সমর কাকুকে কেন ফোন করেছো
তুমি?” 
শিবশঙ্করের পরিতুষ্ট মুখ – “এই মাত্র ডায়েরি ঘেঁটে পেলাম নম্বরটা। শুনেছিলাম ওর
বড়ো ছেলেও পুনেতে থাকে তাই জিজ্ঞেস  -”
“উফ তাই বলেই তুমি ফোন করবে? রাজুদাকে আমি সেই ছোটবেলায় কবে দেখেছি, চিনিও না
ঠিক করে!” 
“বাজে বকিস না তো! একা বিদেশ বিভূঁইয়ে যাচ্ছিস! চেনা লোক পেলে কত সুবিধে হয়
জানিস! নম্বরটা হারাস না। ভালো করে রেখে দে!” – ধমক দেন মেয়েকে একটা।
“মা দেখো বাপি কি শুরু করেছে! ভালো লাগছে না কিন্তু আমার!” – দিয়ার সত্যিই রাগ
হচ্ছে!
শিবশঙ্কর অবশ্য দমলেন না। তিনি এরপর এই নিয়ে পাঁচ বার বিশুদের বাড়ি হানা দিলেন,
মনে করিয়ে দিতে গাড়ি যেন চারটের মধ্যে চলে আসে।
এয়ারপোর্টে গাড়ি থেকে নামতেই ঢ্যাঙা করে একটা ছেলে হাসিমুখে এগিয়ে এল। ঢিপ করে
দিয়ার বাবা-মাকে দুটো নমস্কার ঠুকে বলল – “কাকু আপনারাও যাচ্ছেন না কেন? দিব্যি
পুনেটাও ঘুরে নিতেন এই সুযোগে!”
“যেতে দিলে তো!” – ক্ষুব্ধ শিবশঙ্কর – “বন্ধুরা যাচ্ছে, বাবা মায়ের আর কি
দরকার! তা তুমি বুঝি দিয়ার বন্ধু!” 
দিয়া কটমট করে তাকালো। ও ভালো করেই বুঝছে ওকে খ্যাপানোর জন্য ইচ্ছে করে বলল
কথাটা।  
“হ্যাঁ আমরা এক সাথেই কলেজে পড়েছি।“ – ব্যাগপত্তরগুলো নামাতে নামাতে ছেলেটা
উত্তর দিল।
“বাপি, ও অভীক। আর দুজন কোথায়?” – শেষের প্রশ্নটা অভীকের উদ্দেশ্যে।
“ওই যে গল্পদাদুর আসর জমিয়েছে!” 
দূর থেকে শ্রেয়া আর রাজীব হাত নাড়ল ওদের দেখে। 
“কাকিমা আপনার কি সেন টাইটেল ছিল আগে?” – ব্যাগগুলো ট্রলিতে রেখে হাঁটতে শুরু
করেছে অভীক  
বনলতা এতক্ষণ কিছুই বলছিলেন না, আচমকা এরকম প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলেন। পরক্ষণেই
বুঝতে পেরে হেসে পাল্টা জবাব দিলেন – “আমি তো নাটোরের মেয়ে ছিলাম না কখনও!”
হোহো করে হাসে অভীক। প্রাণখোলা হাসি। তারপর দিয়ার দিকে ঘোরে – “কাকিমার কাছ
থেকে একটু সেন্স অফ হিউমার তো নিতে পারিস!” 
শ্যামবর্ণ, হাড়সর্বস্ব আর লম্বাটে মুখের ছেলেটাকে প্রথম দেখায় বনলতার খুব একটা
ভালো লাগে নি। কিন্তু কথাগুলি আর হাসিটা বেশ মিষ্টি, মনে ছাপ ফেলে যায়।


শ্রেয়ারও মা-বাবা এসেছেন। মিষ্টি ছটফটে মেয়ে। রাজীব আবার অতটাই শান্ত, পরিণত।
বনলতা একটু একটু করে দুশ্চিন্তামুক্ত হচ্ছেন দিয়ার বন্ধুদের দেখে! অল্প হাসছেন
আর ওদের কলেজের নানান মজার কথা শুনছেন। শিবশঙ্কর যথারীতি এদিক ওদিক করে
বেড়াচ্ছেন। এতক্ষণে গোটা এয়ারপোর্টের এমাথা-ওমাথা দু বার পাক খাওয়া হয়ে গেছে
তাঁর। যত সময় এগিয়ে আসছে, চোখ দুটো কেমন শিরশির করে উঠছে। ভয় হচ্ছে সবার সামনেই
কোনো ছেলেমানুষি না করে বসেন। ভেতরে ঢোকার আগে বনলতা দিয়াকে একবার আলাদা করে
ডেকে নিলেন এক পাশে। শিবশঙ্করও তাড়াতাড়ি মা-মেয়ের কথা শোনার জন্য পিছু নিলেন
কিন্তু বউয়ের ধমক খেয়ে আবার ফিরে গেলেন।
“এর মধ্যে কোন জন তিনি?” -বনলতা মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।
“কি বলছ মা এসব!” – অন্ধকার হয়ে এসেছে তাই রক্ষে, নইলে টকটকে লাল মুখটা মা ঠিক
দেখে ফেলত।
“রাতের বেলা ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে আগেই বুঝেছি কি ব্যাপার। তা অভীকই কি সেই
ছেলে?” – হাসছেন। 
দিয়া হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর জড়িয়ে ধরল মাকে – “মা তুমি সত্যি
গ্রেট! কিন্তু বাপিকে প্লিজ কিছু বোলো না। নইলে এখান থেকেই আমাকে বাড়ি নিয়ে চলে
যাবে!” 
“হুম! খারাপ তো মনে হল না ছেলেটাকে!” – থামলেন – “সাবধানে থাকবি আর সবসময় ফোন
করবি আমাদের।” 
“তোমরা একদম ভেবো না আমার জন্য। আর বাপি কিন্তু লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে আজকাল!”
– দিয়া আনন্দের চোটে বাপির সিক্রেটটা ফাঁস করে দিল। 
“তা আর খাবে না! আমরা না ভাবলে কে ভাববে শুনি?” – বনলতার চোখ শুকনো লঙ্কা, তেল,
পেঁয়াজ ছাড়াই জলে চিকচিক করছে।
“তোমার এতো সুন্দর মেকাপটা নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু! কতজন তোমার দিকে তাকাতে
তাকাতে যাচ্ছে বলোতো!” – দিয়া ভালোই জানে সুন্দরী মাকে কিভাবে ভোলাতে হয়!
“ওমা তাই!” – তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে আলতো করে জলটা মুছে নিলেন বনলতা। হেসে
ফেলল দিয়া। ওষুধে কাজ দিয়েছে!          
“বাপি আমরা বোর্ডিং পাস পেয়ে গেছি! তোমরা এবার বেরিয়ে পড়ো। আর কত রাত করবে!” –
বোর্ডিং পাসটা হাতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে দিয়া। 
“তোর প্লেন ছাড়লেই আমরা চলে যাব! আটটা বাজতে আর তো একটা ঘণ্টা বাকি মাত্র! আমরা
দিব্যি বসে আছি এখানে। তুই ভাবিস না তো!” – শিবশঙ্কর মেয়ের কথা কানেই নিলেন না।
নেবেন যে না জানা কথাই। ফোনটা রেখে দিল। সিকিউরিটি চেকের পর ডিপার্চার গেটের
সামনে চেয়ারে বসে পড়ল দিয়া। বাপি আর মায়ের জন্য বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে এখন। কি
করে যে থাকবে ওদের ছেড়ে! রাজীব এসে বসল পাশের চেয়ারে – “কিরে মন খারাপ?”
চুপ করে আছে দিয়া।
“ভয় করছে একা একা যাচ্ছিস বলে?”
“নাহ! তোরা তো আছিস!” – হাসল একটু। 
“বাবা মহারাণীর মুখে হাসি ফুটেছে!” – টিপ্পনী কাটল অভীক। তারপরই উঃ করে উঠলো,
পিঠে শ্রেয়ার থাপ্পড় খেয়ে।

প্রেমের গল্প রোমান্টিক

Loading...

পরের তিনটে বছর দিয়ার জীবনে স্বপ্নের মতো কেটেছে! বাড়ির বাইরে এসে দুটো ডানা
গজিয়েছে পিঠে। উড়ে গেছে যেখানে খুশি। বাপি-মাকে মিথ্যে বলেছে। জিভে লেগেছে
প্রথম ভদকার স্বাদ! যে মেয়ে চা বানাতে জানত না, আজকাল দিব্যি চিকেন মাটন রেঁধে
ফেলছে! মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়েছে, বাপি আর মাও ঘুরে গেছে দুবার। অফিসে,
ফ্ল্যাটে বেড়েছে নতুন বন্ধুর সংখ্যা, পুরনো বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত হয়েছে আরও।
আর অভীকের সাথে সম্পর্কটাও অনেক অনেক গভীর হয়েছে। আত্মবিশ্বাসী, সুখী,
স্বাবলম্বী দিয়া আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে এখন। মাঝে মাঝে
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অভীক – “এরপর তো লোকে আমাকে দেখে ময়ুরের পাশে দাঁড়কাক
বলবে!” 

অভীকের বলার ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলে দিয়া। কিন্তু মনে মনে ও আগের চেয়েও অনেক বেশি
নির্ভর করতে শুরু করেছে ছেলেটার ওপর। যখন সমুদ্রের ধারে দুজনে হাত ধরে হেঁটে
গেছে তখনও, যখন সরু পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় দুজনে এক সাথে নেমে এসেছে তখনও, এমনকি
যখন অফিস থেকে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরেছে তখনও – দিয়ার শুধু মনে হয়েছে এই
ছেলেটা, যার সাথে সারাটা জীবন এক সাথে হেঁটে যেতে পারবে ও, চোখ বন্ধ করে। 
  
“আমার সাথে একবার ডিসকাস তো করবি আগে? আমারও তো একটা মতামত থাকতে পারে এই
ব্যাপারে?” – অভীকের মুখটা বিরক্তিতে ভরে উঠেছে।
না, সত্যিই ভেবে দেখে নি দিয়া। অফিসে ট্র্যান্সফারের কথাটা উঠতেই সানন্দে হ্যাঁ
বলে দিয়েছে আজ। একবারও ভাবেনি অভীকের মত আলাদা হতে পারে।
“আমাদের বাড়ি তো কলকাতাতেই। আজ না হলে কাল তো যেতেই হবে। এক সাথে দুজনের
ট্র্যান্সফার হতও না। এরপর তুইও – “
দিয়ার কথা শেষ হবার আগেই অভীক ঝাঁঝালো স্বরে বাঁধা দিয়ে ওঠে – “আমি কলকাতা যেতে
চাই কে বলেছে তোকে! আমি এখানে ভালো আছি। তোর বাবা-মা অন্ত প্রাণ তুই যা।“ –
হনহন করে হেঁটে চলে গেল অভীক, ফিরেও তাকালো না একবার! 
দিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বাড়ি ফিরছে জেনে অফিসের সবাই খুশি, রাজীব
খুশি, শ্রেয়া খুশি, দিয়া নিজে দারুণ খুশি! সামনে এসে খবরটা দেবে বলে এতক্ষণ
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল। সমস্ত খুশিগুলো কেমন মিথ্যে হয়ে গেল কয়েক
মুহূর্তে।
না, দিয়া মত পাল্টায় নি। শুধুমাত্র নিজে ভালো আছে বলে স্বার্থপরের মতো থেকে
যেতে পারেনি পুনেতে। বাপির মুখটা, মায়ের মুখটা মনে পড়তেই অভীকের রাগও তুচ্ছ হয়ে
উঠেছিল। তবু দিয়া অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু অভীক সত্যিই কলকাতা
ফিরতে চায় না। এখানে বাঁধনছাড়া জীবনে বড়ো বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। 
যাদের সাথে দিয়া পুনেতে প্রথম পা রেখেছিল, তারাই এসেছে ওকে ছেড়ে দিতে
এয়ারপোর্টে। সবারই মনটা ভারী হয়ে আছে। কিন্তু দিয়ার বুকে একটা বিশমনি পাথর চেপে
আছে! এর পর কি হবে! অভীক এখনও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে না ওর সাথে। ও কি কখনও
বুঝবে দিয়া কি চায়?  
কলকাতায় ফেরার পর প্রথম কয়েকদিন অভীক ফোন করেছে নিয়ম করে। তারপরই নিয়মভঙ্গ হতে
শুরু করেছে। কাজে খুব ব্যস্ত থাকে তো আজকাল! অভিমানও হয়েছে। দিয়া অভীকের মন
বুঝে কথা বলে এখন। বেশি ফোন করে না বা আগের মতো কথা বলছে না এই নিয়ে ভুলেও
রাগারাগি করে না। এতো বছরের সম্পর্ক তাদের! অভীকই কি পারবে নাকি দিয়াকে ছেড়ে
বেশিদিন থাকতে! ঠিক একদিন এসে হাজির হবে – “চলে এলাম তোর টানে!” আর দিয়া তখন
হাসবে না কাঁদবে কি যে করবে!
অফিস টাইমে শ্রেয়ার ফোন দেখে খুশি ছেয়ে গেল দিয়ার মুখে।
“কি ম্যাডাম! খবর কি!” – হালকা গলায় বলে ওঠে দিয়া।
“তোর সাথে কথা আছে, অভীকের ব্যাপারে” – একেবারেই তরল মেজাজে নেই শ্রেয়া।
হোঁচট খেলো দিয়া একটু – “বল!”
“তোকে অভীক কিছু বলেছে?”
“না তো! কি বলবে!” – অবাক হচ্ছে দিয়া।
“তোকে ও জানায় নি একটা মেয়ের সাথে আজকাল ঘোরাফেরা করছে! রাজীব বলল মেয়েটা রাতে
এসে থাকছেও ওর ফ্ল্যাটে!”

একটা বড়সড় ধাক্কা খেল দিয়া। পায়ের তলার মাটিটা নড়ে উঠল যেন। এসব কি বলছে
শ্রেয়া! অভীক! মেয়ে! রাতে থাকা! কি বলছে এসব!

“হ্যালো? হ্যালো? শোন তুই ফোন করবি এখুনি ওকে। আমি পরে ফোন করছি তোকে।“ –
শ্রেয়া কেটে দিল ফোন।
দিয়ার মাথাটা ঘুরছে কেমন। এখন কি করবে ও? অভীককে ফোন করবে? জিজ্ঞেস করবে?
কিন্তু যদি মিথ্যে হয়? অভীক ভাববে না যে, দিয়া ওকে সন্দেহ করে?
“কথাটা সত্যি?” – দিয়ার গলাটা বুজে এসেছে।
ওপাশে রাজীব চুপ করে আছে। কি জবাব দেবে! 
“ও! কি নাম মেয়েটার?”
“মোনালিসা” – রাজীব আস্তে আস্তে বলে নামটা
“কবে থেকে চলছে?” – হৃৎপিণ্ডটাই থেমে গেছে বুঝি দিয়ার।
“তুই কলকাতায় ফেরার আগে থেকেই।”
“ও! তুই জানতিস! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও আমাকে জানানো উচিত মনে করিস নি
তাহলে?”
ফোন কেটে দিয়ে পায়ে পায়ে কোণের বাথরুমটায় আসে। লোকজন আসেনা বড়ো একটা এদিকটায়।
ওদিক থেকে রাজীব ফোন করেই যাচ্ছে। কেটে দিয়ে অভীকের নম্বরটা ডায়াল করে দিয়া।
“পরে ফোন করছি তোকে। একটা মিটিং এ আছি” – ব্যস্ত শোনায় অভীকের গলা।
“বেশি সময় নেব না। তোর মুখে একবার শুনতে চাই, যা শুনলাম সত্যি?” – দিয়া এখনও
বিশ্বাস করতে পারছে না। এখনও ভাবছে কোথাও কিছু গোলমাল আছে! এখনও ভাবছে এই বুঝি
অভীক হেসে বলবে কেমন বোকা বানালাম বল!
“কার কাছে শুনলি?” – বহু যুগ পর ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল।
“সত্যি?”  
“হ্যাঁ। তোকে বলব বলব করে বলা হয় নি!”
“কেন করলি এরকম?” – দিয়া এবারে সত্যিই ভেঙে পড়েছে। ভুলে গেছে সে অফিসে আছে।
ভুলে গেছে উল্টোদিকের ছেলেটা সামনে নেই! হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে গিয়ে। ফোনটাকেই
জোরে খামচে ধরেছে অভীক ভেবে!
“তোর কি ধারণা! আমি বাড়ির বাইরে পড়ে আছি শুধু চাকরী করতে? আমি আমার মতো জীবন
কাটাতে চাই বুঝলি! তোর যেমন কলকাতা ছাড়া সম্ভব না, আমারও তেমন দায় না তোকেই
ভালোবাসবার! তাছাড়া মোনালিসাকে আমার ভালো লাগে। মানছি তোকে একবার বলা উচিত ছিল,
কিন্তু আমার লাইফ স্টাইল নিয়ে কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই আমি। মাই লাইফ মাই
ওয়ে! আর কিছু বলবি? আমার একটা মিটিং শুরু হবে এখন।”
ধড়ফড় করে ফোন রেখে দিয়েছে দিয়া! গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে উঠেছে। নিঃশ্বাস
নিতেও কষ্ট হচ্ছে দিয়ার! এই সেই ছেলেটা যে কলেজ ফেস্টে তার কবিতা শুনে মুগ্ধ
হয়ে বসে ছিল এমন কি হাততালিও দিতে ভুলে গেছিলো? এই কি সেই সাদামাটা অভীক যাকে
ভালবাসতে দিয়ার কোনও দ্বিধাই ছিল না সেই প্রথম দিন থেকে! এই অভীকই কি সেই যার
সাথে সাক্ষী আছে অজস্র খুশির মুহূর্ত? তারায় ভরা কত রাত হেঁটেছে সে কি এই
অভীকের সাথে? দিয়া আবার ফোন করেছে। শুধু একবার শোনার আশায় – ও যা করেছে ভুল করে
করেছে। সব ভুলে যাবে তাহলে দিয়া।   
“আমি আর পারছিনা! কেন করলি এরকম? প্লিজ কিছু তো বল!” – ওপাশ থেকে এল না কোনও
জবাব।
দিয়া এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। তার কষ্ট-যন্ত্রণার ভাগ কেউ
নিয়ে নিতে পারে নি। যন্ত্রের মতো অফিস যায়, বাড়িও আসে। কিন্তু কোথায় যেন সব সুর
কেটে গেছে। বনলতা মাঝে মাঝে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, মুখে কিছুই বলেন না।
শিবশঙ্করও আজকাল নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে বলে ওঠেন এক এক সময় – “যা না মা
বন্ধুদের সাথে কোথাও বাইরে গিয়ে ঘুরে আয় না! কি সারাদিন বাড়িতে বসে আছিস!”।
দিয়া নিজের ঘরে চলে এসেছে। না, কোথাও যেতে চায় না সে।
“হ্যাপি বার্থডে দিয়া!” – বন্ধুরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নেভালো দিয়া। অফিসের বন্ধুরা বড়ো একটা কেক কিনে এনেছে ওর
জন্য। ক্যাফেটেরিয়ায় কাটা হচ্ছে সেই কেক। ও হ্যাঁ, আরেকটা কেকও এসেছে অনলাইন
কেকশপ থেকে। অভীক পাঠিয়েছে! সকালে মোবাইলে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানিয়েছে। এই
কমাসে এই প্রথম তার দিক থেকে কোনো সাড়া পেল দিয়া। দিয়াই কোনও জবাব দিতে পারে
নি। রাজীবের কাছে শুনেছে মোনালিসা না, মীনাক্ষীই এখন নতুন মেয়ে অভীকের জীবনে।
ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেকটা পড়ে আছে এক পাশে। দিয়ার মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল।
আশ্চর্য এতো বছরের সম্পর্ক অথচ অভীক জানেই না যে ভ্যানিলা ফ্লেভার তার কতটা
অপছন্দ! কেক খাওয়া হলে ছুড়িটা বাগিয়ে ধরল প্রিয়া একহাতে! দিয়ার বন্ধুরাও এই
কমাস দেখেছে দিয়াকে, ওর যন্ত্রণাকে। ছুড়িটা নিয়ে বিশাল এক কোপ বসাল প্রিয়া
অভীকের পাঠানো কেকটার ওপর। তারপর একে একে সবাই, এক বুক ঘৃণা নিয়ে, হয়তো অভীকের
মুখটা মনে করেই কেকটার ওপর এলোপাথাড়ি ছুড়ি চালাতে লাগল! দিয়া পারে নি এতোটা
হিংস্র হতে। অন্যদের বাঁধাও দিলনা অবশ্য। চোখের কোণটা কেমন শিরশির করে উঠেছে
শুধু! অফিসের বাইরে চা খেয়ে ফিরতে গিয়ে খেয়াল হল কার্ডটা ক্যাফেটেরিয়াতেই রয়ে
গেছে। এই সময়টায় ক্যাফেটেরিয়া পুরোই ফাঁকা থাকে। কেকটা এখনও পড়ে আছে টেবিলের
ওপর, একা, নিজের বীভৎসতা নিয়ে। কোনও ভাবেই আর গ্রহণযোগ্য নয়। দিয়াও যেন কেক নয়
সামনে অভীককেই দেখছে। তার বুক থেকে সমস্ত যন্ত্রণাটা নিংড়ে ঘৃণা হয়ে নামতে শুরু
করল হঠাৎ, তারপর একেবারেই মিলিয়ে গেল যেন। “তোর নোংরামো আমার ঘৃণা দিয়ে শোধ করে
দিলাম রে” – বিড়বিড় করে উঠল দিয়া। তারপর চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা কার্ডটা তুলে
নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল। 
আরো পড়ুন,  বাসর রাতের গল্প


“মা আজ এত্তো গিফট পেয়েছি জানো!” – দিয়ার গলায় আগের মতোই উত্তেজনা, ছেলেমানুষি
মাখানো – “তোমাকে বাড়ি গিয়ে দেখাবো! আর ওই পায়েসটা একটু বেশি করে করবে? কাল
বন্ধুদের জন্য নিয়ে আসব!” – বহুদিন বাদে মেয়েটা আবার স্বাভাবিক ভাবে কথা বলল,
আবার কিছু আবদার করল! চোখটা মুছে বনলতা তাড়াতাড়ি শিবশঙ্করকে বাজারে পাঠালেন
পায়েসের সরঞ্জাম কিনতে।
প্রিয় গল্প পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইটে। 
ভালো থাকুন, ভালোবাসায় থাকুন। ..
Thank You, Visit Again…


Share This Article