Taslima Nasrin Lojja Read Online (লজ্জা) Lojja PDF

Bongconnection Original Published
43 Min Read



Taslima Nasrin Lojja Read Online (লজ্জা) Lojja PDF

Taslima Nasrin Lojja Read Online (লজ্জা) Lojja PDF
Loading...

 সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে–‘দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর। দেরি হলে কিন্তু অঘটন ঘটে যেতে পারে।’ সুরঞ্জন জানে এই ব্যবস্থার নামে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকা। ইঁদুর যেমন গর্তে ঢোকে ভয়ে, ভয় কেটে গেলে বা পরিস্থিতি শান্ত হলে চারদিক দেখেশুনে লুকোনো জায়গা থেকে ইঁদুর যেমন বেরিয়ে আসে; তেমনই তাদেরও লুকোতে হবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে এদিক ওদিক দেখে তবেই বেরোতে হবে লুকোনো জায়গা থেকে। কেন সুরঞ্জনকে নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে হবে–-তার নামে সুরঞ্জন দত্ত বলে? বাবার নাম সুধাময় দত্ত, মায়ের নাম কিরণময়ী দত্ত, বোনের নাম নীলাঞ্জনা দত্ত বলে বাবা, মা, বোনকে বাড়ি ছাড়তে হবে? কালাম, বেলাল বা হায়দারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে যেমন নিয়েছিল দু বছর আগে? তিরিশে অক্টোবর সকালে কামাল তার ইস্কাটনের বাড়ি থেকে কিছু একটা আশঙ্কা আঁচ করে ছুটে এসেছিল, সুরঞ্জনকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে বলেছিল–‘শিগরি চল, দু-চারটে কাপড়চোপড় তড়িঘড়ি গুছিয়ে নে। বাড়িতে তালা দিয়ে সবাই চল তো। দেরি করিস নে, চল চল।’ কামালের বাড়িতে তাদের যত্নআত্তির অভাব হয়নি, সকালে ডিম রুটি–দুপুরে মাছ ভাত–বিকেলে লনে বসে ধুম আড্ডা–রাতে পুরু গদির বিছানায় ঘুম, চমৎকার কেটেছিল। কিন্তু কেন তাকে কামালের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়! কামাল তার অনেক দিনের বন্ধু। আত্মীয়স্বজন নিয়ে তার বাড়িতে ক’দিন সে থাকতে পারে কিন্তু তাতে থাকতেই হবে কেন? তাকে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, কামালকে তো পালাতে হয় না? এই দেশ কামালের যতটুকু, সুরঞ্জনেরও ঠিক ততটুকু। নাগরিক অধিকার দুজনের সমান হবারই কথা। কিন্তু কামালের মত সে কেন উদ্ধত দাঁড়াতে পারে না! সে কেন দাবি করতে পারে না আমি এই মাটির সন্তান, আমার যেন কোন আমার যেন কোনও অনিষ্ট না হয়!
সুরঞ্জন শুয়েই থাকে, ওঠে না। মায়া এঘরে ওঘরে অস্থির হাঁটে। বোঝাতে চায় কিছু একটা ঘটে গেলে পরে দুঃখ করে লাভ নেই। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে স্তব্ধ বসে আছেন সুধাময় আর কিরণময়ী। তাঁরাও ভাবছেন সুরঞ্জয় বুঝি এবারও নব্বই-এর অক্টোবরের মত কোনও মুসলমান বাড়িতে তাঁদের লুকোতে নেবে। কিন্তু আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুরঞ্জনের। সারাদিন শুয়েই কাটাবে সে ভাবে। কামাল বা কেউ নিতে এলে বলবে–‘বাড়ি ছেড়ে যাবো না, যা হয় হোক।’

Lajja By Taslima Nasrin

Loading...

আজ ডিসেম্বরের সাত তারিখ। গতকাল দুপুরে অযোধ্যার সরযূ নদীরে তীরে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করসেবকরা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তিনটি গুম্বুজসহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরং দলের সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পি এ সি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের নৃশংস কাণ্ড দেখে। দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে একটি গম্বুজ ভাঙা হয়, চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটে পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজও ভেঙে ফেলে উম্মত করসেবকরা। সৌধ ভাঙতে গিয়ে চারজন করসেবক ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক।






সুরঞ্জন শুয়ে শুয়েই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোয়। আজ ব্যানার হেডিং–‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত।’ সে অযোধ্যায় যায়নি। বাবরি মসজিদ দেখেনি। দেখবে কী করে, দেশের বাইরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি। রাম কোথায় জন্মেছিল, আর তার কোন মাটি ফুঁড়ে মসজিদ গজিয়েছে এসব তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। তবে ‘ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে যে কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত; সমগ্র কল্যাণবোধের ওপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত’–এ কথা সে মানে। ‘বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ নিয়ে হয়ে যাবে প্রচণ্ড তাণ্ডব। মন্দিরগুলো ধুলিস্যাৎ হবে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়বে, দোকানপাট লুট হবে। বি জে পি-র উস্কানিতে করসেবকেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে এ দেশের মৌলবাদী দলকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করছে। বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগীরা কি তাদের উন্মত্ত আচরণের জের কেবল ভারতের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে ভেবেছে? ভারতে শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মরছে পাঁচশ ছশ একহাজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দুর স্বার্থরক্ষকরা কি জানে দু থেকে আড়াই কোটি হিন্দু এই বাংলাদেশে আছে? শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু রয়েছে, তাদের কী দুর্দশা হবে হিন্দু মৌলবাদিরা একবার ভেবেছে? রাজনৈতিক দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির জানা উচিত ভারত কোনও বিচ্ছিন্ন জম্বুদ্বীপ নয়। ভারতে যদি বিষফোঁড়ার জন্ম হয় তার যন্ত্রণা শুধু ভারতই ভোগ করবে না, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে, অন্তত প্রতিবেশী দেশে তো সবার আগে।’
সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তার গা ধাক্কা দিয়ে মায়া বলে–তুমি উঠবে কি না বল। বাবা মা তোমার ভরসায় বসে আছেন।
সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে–তোর ইচ্ছে হলে তুই চলে যা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না।
–আর ওঁরা?
–জানি না।
–যদি কিছু হয়?
–কী হবে!
–ধর, বাড়ি লুট করল। পুড়িয়ে ফেলল।
–ফেলবে।
–তুমি তার পরও বসে থাকবে?
–বসে না, শুয়ে থাকব।
সুরঞ্জন খালি পেটে একটা সিগারেট ধরায়। তার চায়ের তেষ্টা পায়। কিরণময়ী সকালে এক কাপ চা তাকে দেন, আজ দিচ্ছেন না। এ সময় তাকে কে দেবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। মায়াকে বলা বৃথা। পালাবার কথা ছাড়া আপাতত মেয়েটি কিছুই ভাবছে না। চা বানাতে বললে ওর গলা আবারও সপ্তমে চড়বে। সে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতে অয়ারে, কিন্তু আলস্য তাকে ছাড়ছে না। ওঘরে টেলিভিশন চলছে। তার ইচ্ছে হয় না সি এন এন-এর সামনে চোখ গোল গোল করে বসে থাকতে। ওঘরে খানিক পর পর মায়া চেঁচিয়ে উঠছে–দাদা শুয়ে আছে, পেপার পড়ছে, তার কোনও হুঁশ নেই।
হুঁশ সুরঞ্জনের নেই এ কথা ঠিক নয়। সে ঠিকই বোঝে যে কোন সময় দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে একদঙ্গল লোক, তাদের কতক চেনা কতক অচেনা, তারা বাড়ির জিনিপত্র ভাঙবে, লুট করবে, আর যাবার সময় বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেবে। এ অবস্থায় কামাল বা হায়দারের বাড়িতে উঠলে কেউ বলবে না আমাদের জায়গা নেই। কিন্তু তার খুব লজ্জা হয় যেতে। মায়া চেঁচাচ্ছে–তোমরা না যাও আমি একাই তবে চলে যাই। পারুলের বাড়ি গিয়ে বসে থাকি। দাদা কোথাও নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার না হয় বেঁচে থাকার দরকার নেই, আমার আছে।
মায়া ধারণা করছে সুরঞ্জন যে কারণেই হোক আজ কারও বাড়িতে তাদের লুকোতে নেবে না। অগত্যা সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি সুরঞ্জনকে ভোগায় খুব।
নিরাপত্তা নব্বই-এর অক্টোবরেও ছিল না। ঢাকেশ্বরী মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দিল একদল লোক। পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, বাধা দিল না। পুড়ে গেল মূল মন্দির, ওরা ধ্বংস করে ফেলল নাটমন্দির, শিবমন্দির, অতিথিশালা, অতিথিশালার পাশে শ্রীদাম ঘোষের বাস্তুভিটে। মন্দিরের ভেতরের জিনিসপত্র লুট করল। মাধব গৌড়িয় মঠের মূল মন্দির ধ্বংস করল। ওদিকে জয়কালী মন্দির চূর্ণ করে দিল। ব্রাহ্ম সমাজের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরের ঘরটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিল। রামসীতা মন্দিরের ভেতর কারুকাজ করা ঠাকুরের সিংহাসনটি বিধ্বস্ত করে ফেলল। বিধ্বস্ত করল মূল ঘর। নয়াবাজারের মঠ ভেঙে ফেলল। বনগ্রাম মন্দির ভেঙে ফেলল শাবল চালিয়ে। শাঁখারি বাজারের মুখে সাতটি হিন্দুর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হল। শিলা বিতান, সোমা ট্রেডার্স, সেলুন, টায়ারের দোকান, লণ্ড্রি, মিতা মার্বেল, সাহা কেবিন, রেস্টুরেন্ট কিছুই রক্ষা পেল না। শাঁখারি বাজারের মোড়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল যে যতদূর চোখ যায় ধ্বংসের চিহ্ন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। ডেমরায় শনির আখড়ার মন্দির লুট হল। পঁচিশটি পরিবারের বাড়িঘর লুট করল দু’তিনশ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী। লক্ষ্মী বাজারের বীরভদ্রের মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ভেতরের সব নষ্ট করে দিল। ইসলামপুর রোডের ছাতা আর সোনার দোকানগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকান ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলল পুরানা পল্টনের মরণচাঁদও। রায়ের বাজারের কালী মন্দিরের মূর্তি মাটিতে ফেলে ভাঙল। সূত্রাপুরে হিন্দুদের দোকান লুট কর, ভেঙে, মুসলমানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের ঘোষ এণ্ড সন্স-এর মিষ্টির দোকানটি লুটপাটের পর নবাবপুর যুব ইউনিয়ন ক্লাব-এর একটি ব্যানার দোকানের ওপর টাঙিয়ে দিল। ঠাঁটারি বাজারের বটতলি মন্দির ভেঙে তছনছ করা হল। নবাবপুরে রামধন পশারি নামের পুরনো দোকানটি লুট করা হল। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র কয়েক গজের মধ্যে শুকলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ভেঙে চুরমার করা হল। যতীন এণ্ড কোং-এর দোকান এবং কারখানা ভেঙে ফেলল, ঘরের জিনিসপত্র পুড়ল। ঐতিহাসিক সাপ মন্দিরের অনেকটা গুঁড়ো করে ফেলল, সদরঘাট মোড়ে রতন সরকারের মার্কেট লুটপাট করল, ভাঙচুর করল। সুরঞ্জনের চোখের সামনে একটি একটি করে ভেসে ওঠে ভাঙা পোড়া সেইসব বীভৎস দৃশ্য। এর নাম কি দাঙ্গা? নব্বই-এর ঘটনাকে কি দাঙ্গা বলা যায়? দাঙ্গা অর্থ মারামারি–এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের নাম দাঙ্গা। কিন্তু একে তো দাঙ্গা বলা যায় না, এ হচ্ছে এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায়ের হামলা। অত্যাচার। নির্যাতন। জানলা গলে রোদ এসে পড়ে সুরঞ্জনের কপালে। শীতের রোদ, এ রোদে গা পোড়ে না। শুয়ে থেকে সে চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করে।

এখনও সেইসব দৃশ্য সুধাময়ের চোখে ভাসে। কাকা পিসি মামা মাসিমা একে একে চলে যাচ্ছেন। ময়ময়সিংহ জংশন থেকে ট্রেন ছাড়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে। কয়লার ইঞ্জিন এক আকাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে যখন পুঁউউ হুইসেল বাজায়, ট্রেনের কমপার্টমেট থেকে বুক ভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসে। পাড়া-পড়শিও যাচ্ছে আর তাগাদা দিচ্ছে—‘সুকুমার, এ হচ্ছে মুসলমানের হোমল্যান্ড। এখানে নিজের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নেই।’ সুকুমার দত্ত এক কথার লোক, তিনি বললেন—‘নিজের জন্মের মাটিতে যদি নিরাপত্তা না থাকে, নিরাপত্তা তবে পৃথিবীর কোথায়? দেশ ছেড়ে পালাতে আমি পারব না। তোমরা যাচ্ছ যাও। আমার বাপ ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। নারকেল সুপুরির বাগান, ধানি জমি, দু বিঘার উপর বাড়ি—এসব ছেড়ে শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তু হব এ আমার ইচ্ছে নয়।’ সুধাময়ের তখন উনিশ বছর বয়স। কলেজের বন্ধুরা চোখের সামনে চলে যাচ্ছে, বলছে—‘তোর বাবা কিন্তু পরে পস্তাবে।’ সুধাময় তখন বাবার মত বলতে শিখেছেন—‘নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাব কেন? মরলে এই দেশেই মরব, বাঁচলে এই দেশেই।’ কলেজ ফাঁকা হয়ে গেল সাতচল্লিশে, যারা যায়নি, তারা যাব যাব করছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান ছাত্র আর রয়ে যাওয়া কিছু দরিদ্র হিন্দুর সঙ্গে কলেজ পার করে লিটন মেডিকেলে লেখাপড়ে করলেন সুধাময়।
বাহান্নোয় চব্বিশের টগবগে যুবক তিনি। ঢাকার রাস্তায় তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে সাহসী ও সচেতন বাঙালি তরুনেরা। তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নত ন্যুব্জ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে, মিছিলে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, রক্তে রাজপথ ভেসে যায়, তবু কেউ দাবি ছাড়েনি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করবার দাবি। সুধাময়ের তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ‘বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়েছেন। পুলিশের গুলিতে যেদিন রফিক সালাম বরকত জব্বার প্রাণ হারান, সুধাময় ছিলেন সেই মিছিলে। তাঁর বুকেও লাগতে পারত গুলি। তিনিও হতে পারতেন এ দেশের মহান শহীদদের একজন।
উনসত্ত্রের গনআন্দোলনেও সুধাময় ঘরে বসে থাকেননি। আয়ুব খানের পুলিশবাহিনী তখন মিছিল দেখলেই গুলি ছোঁড়ে, এগারো দফা নিয়ে বাঙালি তবু মিছিলে নামা ছাড়ে না। পুলিশের গুলিতে নিহত আলমগীর মনসুর মিণ্টুর লাশ কাঁধে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহের রাস্তায় হেঁটেছেন, পেছনে শত শত শোকস্তব্ধ বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আরেকবার মুঠো শক্ত করেছে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ কথা প্রমাণ করেছে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হওয়া ছিল ভুল একটি সিদ্ধান্ত। আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন– It is one of the greatest frauds on the people to suggest that religious affinity can unite areas which are geographically, economically and culturally different. It is true that islam sought to establish a society which transcends racial, linguistic, economic and political forntiers. History has however proved that after the first few decades or at the most after the first century, Islam was not able to unite all the muslim countries on the besis of Islam alone.
জিন্নাহও জানতেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাড়তার কথা। মাউন্টব্যাটেন যখন পাঞ্জাব আর বাংলা ভাগ করবার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন জিন্নাহ নিজেই বলেছিলেন—A man is Punjabi or a Bengali before he is Hindu or Moslem. They share a common history, language, culture and economy. You must not divide them. You will curse endless bloodshed and trouble.

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি Endless bloodshed and trouble দেখেছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এক লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা একথা প্রমাণ করেছে যে, ধর্ম কখনও জাতিসত্তার ভিত্তি নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসই জাতি গঠনের ভিত্তি। পাঞ্জাবি মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের একজাতিত্ব একদিন পাকিস্তান এনেছিল সত্য কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা ভেঙে এদেশের বাঙালিরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে আপস করেনি।
একাত্তরে সুধাময় ছিলেন ময়মনসিংহের এস কে হাসপাতালের ডাক্তার। ঘরে বাইরে ব্যস্ততা তখন, বিকেলে স্বদেশিবাজারের এক ওষুধের দোকানে প্র্যাকটিস করেন। কিরণময়ীর কোলে ছ’মাসের বাচ্চা, বড় ছেলে সুরঞ্জনের বয়স বারো। দায়িত্ব কম নয়। হাসপাতালও প্রায় একা সামলাতে হয়। সময় পেলে শরিফদের আড্ডায় যান। তখন মার্চের আট কী নয় তারিখ হবে। রেসকোর্সের মাঠে শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ শুনে এসেছে ওরা, শফিক বাবলু ফয়জুল নিমাই, রাত বারোটায় ওরা কড়া লাগে সুধাময়ের ব্রাহ্মপল্লীর বাড়ির দরজায়। শেখ মুজিব বলেছেন—‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তবে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ওরা উত্তেজনায় কাঁপে। টেবিল চাপড়ে বলে—‘সুধাদা, কিছু একটা করতেই হবে।’ বসে থাকলে যে চলবে না সুধাময়ও বুঝেছিলেন। তারপর পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সৈন্য যখন বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আবার কড়া নড়েছিল সুধাময়ের দরজায়, ফিসফিস করে ওরে বলেছিল—‘যুদ্ধে যেতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’ তাঁর ভরা সংসার, বয়সটাও যুদ্ধে যাবার জন্য সুবিধের নয়। তবু হাসপাতালে তাঁর মন বসে না; করিডরে একা পায়চারি করেন। যুদ্ধে যাবার তীব্র একটি ইচ্ছে মাঝে মাঝেই তাঁকে গ্রাস করে। ঘরে তিনি অন্যমন, কিরণময়ীকে বলেন—‘কিরণ, তুমি কি একা সামলাতে পারবে সংসার? ধর, আমি কোথাও চলে গেলাম।’ কিরণময়ী নীল হয়ে যান আশঙ্কায়, বলেন—‘চল ইন্ডিয়া চলে যাই। আশেপাশের সবাই চলে যাচ্ছে।’
সুধাময় নিজেও লক্ষ্য করেছেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু হালদার, নির্মলেন্দু ভৌমিক, রঞ্জন চক্রবর্তী সব চলে যাচ্ছে, সাতচল্লিশে যেমন চলে যাবার ধুম পড়েছিল, তেমন। ওদের তিনি কাওয়ার্ড বলে গাল দিতেন। নিমাই একদিন সুধাময়কে বলল—‘সুধাদা, আর্মিরা শহরের রাস্তায় হাঁটছে, ওরা হিন্দু ধরছে, পালাই চলুন।’ সাতচল্লিশে সুকুমার দত্তের কণ্ঠে যে জোর ছিল, সেই জোর সুধাময় তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেন। তিনি নিমাইকে বললেন—‘তুমি যাচ্ছ যাও, আমি পালাচ্ছি না। পাকিস্তানি কুকুরগুলোকে মেরে স্বাধীন করব দেশ। আর তখন পারো তো ফিরে এস।’
ঠিক হল ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি ফুলপুরে কিরণময়ীদের রেখে শরিফ বাবলু ফয়জুলের সঙ্গে নালিতাবাড়ির দিকে তিনিও চলে যাবেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন পাকিস্তানি আর্মির হাতে। তালা কিনতে বেরিয়েছিলেন, চরপাড়া মোড়ে কোনও তালা পাওয়া যায় কি না, বাড়িতে তালা দিয়ে রাতের অন্ধকারের মোষের গাড়িতে উঠবেন। উত্তেজনায় আবেগে বুক কাঁপছে তার। শ্মশানের মত শহরটি। শুনশান। দু-একটি দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। হঠাৎ হল্ট বলে ওরা আটকালো তাঁকে। তিনজন ছিল ওরা। একজন তাঁর পেছন থেকে সার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল—নাম কেয়া হ্যায়?
সুধাময় কী নাম বললেব বুঝে পাননি। তার মনে পড়ল কিরণময়ী বলেছিলেন তাকে নাকি পাড়ার লোকেরা বলেছে বেঁচে থাকতে চাইলে নাম পাল্টাতে, ফাতেমা আখতার জাতীয় কিছু রাখতে। সুধাময় ভাবেন তার হিন্দু নামটি নিশ্চয় এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তিনি বিস্মৃত হন তার নাম, পিতা সুকুমার দত্ত, ঠাকুরদা জ্যোতির্ময় দত্তের নাম। সুধাময় নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে ওঠেন যখন নিজের নাম তিনি বলেন—সিরাজউদ্দিন হোসেন। নাম শুনে একজন মোটা গলায় চেঁচালো—লুঙ্গি খোল। লুঙ্গি সুধাময় খোলেননি, ওরাই টান মেরে খুলেছিল। সুধাময় তখন বুঝেছিলেন নিমাই সুধাংশু রঞ্জন কেন পালিয়েছিল। ভারত ভাগের পর দেশ ত্যাগ করেছে প্রচুর হিন্দু। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার পর হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খোলা ছিল। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীরা ভারত চলে যান।




১৯৮১ সালের লোক সেনসাস মতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১ কোটি ৫ লক্ষ ৭০ হাজার অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১২.১ শতাংশ। বারো বছরে এ সংখ্যা বেড়ে নিশ্চয় দু কোটিতে দাঁড়িয়েছে অথবা আড়াই কোটি। সরকারি হিসেবে হিন্দু সংখ্যা কমিয়ে বলা হয়। সুধাময় অনুমান করেন মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিন্দু আছে দেশে। ১৯০১ সালের হিসেব বলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু ছিল ৩৩.০ শতাংশ, ১৯১১ সনে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩১.৫ শতাংশ। ১৯২১ সনে ৩০.৬ শতাংশ। ১৯৩১ সালে ২৯.৪ শতাংশ। ১৯৪১-এ ২৮ শতাংশ। ৪১ বছরে ভারত ভাগের আগে হিন্দু কমে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৪০ বছরে যা হ্রাস পায়নি, ১০ বছরে তার চেয়ে বেশি হ্রাস পেল। পাকিস্তান আমলে হিন্দুরা চলে যেতে থাকে ভারতে। ১৯৬১ সালের হিসাবে হিন্দু সংখ্যা ১৮.৫ শতাংশে দাঁড়ায়, ১৯৭৪ সালের হিসেবে ১৩.৫ শতাংশে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে হিন্দুসংখ্যা হ্রাসের হার কমে যায় অনেকটা বিভাগপূর্ব কালের মত। ১৯৭৪ সালে হিন্দু জনসংখ্যার হার ১৩.৫ শতাংশ এবং ১৯৮১ সালে যদি ১২.১ শতাংশ হয়, তবে তো নিশ্চয় করে বলা যায় যে, সংখ্যালঘুরা ভিটে ছাড়ছে আগের চেয়ে কম। কিন্তু কত সাল অবধি এই সংখ্যা কম? তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি, ঊননব্বই, নব্বই? নব্বই-এর পর কি হিন্দুসংখ্যা হ্রাস পাবে না দেশে? বিরানব্বই-এর পর?
সুধাময়ের বুকের বাঁদিকে ব্যথা শুরু হয়। পুরনো ব্যথা। মাথার পেছনেও যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ এলেই অফ করে দেয়া হচ্ছে দৃশ্য। সুধাময় অনুমান করেন, এই দৃশ্য দেখে লোকে হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাই সরকার দয়া করছেন। কিন্তু আঁচড় লাগলেই ঝাঁপিয়ে পড়া অভ্যেস যাদের, তারা কী আর সি এন এন-এর দৃশ্য দেখবার অপেক্ষা করবে? সুধাময় বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে শুয়ে পড়েন। মায়া তখনও অস্থির পায়চারি করছে ঘরে বারান্দায়। সে কোথাও চলে যেতে চাইছে। সুরঞ্জন না উঠলে কোথাও যাওয়াও তো সম্ভব হচ্ছে না। সুধাময় অসহায় দৃষ্টি ফেলে রাখেন রোদ পড়া বারান্দায়। দীর্ঘ হচ্ছে মায়ার ছায়া। কিরণময়ী স্থির বসে আছেন, তাঁরও চোখে কাতর অনুনয়—চল বাঁচি। চল চলে যাই। ঘর বাড়ি ছেড়ে যাবেন কোথায় সুধাময়! এই বয়সে তাঁর পক্ষে কী আগের মত দৌড়ঝাঁপ সম্ভব! আগে যেমন মিছিল দেখলেই দৌড়োতেন। পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে যে কোনও আন্দোলনে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। ঘর তাকে আটকে রাখতে পারেনি। সেরকম শক্তি কোথায় তার আর! তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশে হিন্দুরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামো থেকে খসে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম এখন ইসলাম। যে মৌলবাদী দলটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, আর দেশ স্বাধীনের পর গর্তের মধ্যে লুকিয়েছিল তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, মিছিল মিটিং করে, তারাই নব্বই-এর অক্টোবরে হিন্দুর মন্দির, ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। সুধাময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। এবার কী হবে তিনি জানেন না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে উগ্র উন্মত্ত হিন্দুরা। তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এখন বাংলাদেশের হিন্দুদের। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সুধাময়রা মৌলবাদী মুসলমানের থাবা থেকে নব্বই-এ মুক্তি পায়নি, বিরানব্বই-এ পাবে কেন? এবারও সুধাময়দের ইঁদুরের গর্তে লুকোতে হবে। কেন, হিন্দু বলে? যেহেতে হিন্দুরা ওখানে মসজিদ ভেঙেছে? এই দায় কেন সুধাময়ের হবে! তিনি আবার বারান্দায় মায়ার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছায়াটি নড়ছে, কোথাও স্থির থাকছে না। ছায়াটি নড়তে নড়তে একসময় অদৃশ্য হয়। মায়া ঘরে ঢোকে। শ্যামল মায়াবী মুখখানায় ঘামের বিন্দুর মত আশঙ্কা জমছে। মায়া বলে, চেঁচিয়েই বলে—তোমরা তা হলে এখানেই পড়ে থাকো, আমি যাচ্ছি।
কিরণময়ী ধমকে ওঠেন—কোথায় যাবি?
মায়া দ্রুত চুল আঁচরায়। বলে—পারুলদের বাসায়। তোমাদের যদি বাঁচতে ইচ্ছে না হয় আমার করার কিছু নেই। দাদাও মনে হয় কোথাও যাবে না।
–আর তোর নীলাঞ্জনা নামটি কী করবি? সুধাময় মাথা তুলে প্রশ্ন করেন। মুহূর্তে তার মনে পড়ে নিজের সিরাজউদ্দিন নামটির কথা।
মায়ার কণ্ঠ কাঁপে না। বলে—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে নাকি মুসলমান হওয়া যায়, তাই হব, নাম হবে ফিরোজা বেগম।
–মায়া! কিরণময়ী মায়াকে থামাতে চান।
মায়া ঘাড় কাত করে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন সে মন্দ কিছু বলছে না, এটিই হওয়া স্বাভাবিক। কিরণময়ীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন হয় না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকান একবার মায়ার মুখে, একবার কিরণময়ীর মুখে। মায়া ছটফট করছে। একুশ বছরের প্রাণবান তরুণী মায়া, সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেনি সে, পঞ্চাশ বা চৌষট্টির দাঙ্গা দেখেনি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বুদ্ধি হবার পর দেখেছে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, দেখেছে সে এবং তার পরিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের অনেকরকম আপস করতে হয় সমাজের সঙ্গে। দেখেছে সে নব্বই-এর লেলিহান আগুন। জীবন জীবন বাঁচাতে মায়া এখন যে কোনও চ্যালেঞ্জে যেতে প্রস্তুত। মায়া পুড়তে চায় না অন্ধ আগুনে। সুধাময়ের দৃষ্টির শূন্যতা মায়াকে গ্রাস করে নেয়। তার সামনে মায়া বলে আর কেউ থাকে না। তার বুকের ভেতর তীব্র একটা যন্ত্রণা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।

   দ্বিতীয় পর্ব

সুরঞ্জনের চায়ের তৃষ্ণাটি যায় না। সে উঠে কলঘরে যায়। মুখ না ধুয়েই এক কাপ চা খেতে পারলে ভাল হত। মায়ার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি কি চলেই গেল! সুরঞ্জন দাঁত মাজে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মাজে। বাড়িতে অদ্ভুত এক থমথমে ভাব, যেন এক্ষুণি কেউ মরবে। এক্ষুণি বাজ পড়বে বাড়িতে, সবার যার যার মৃত্যের অপেক্ষা করছে। সুরঞ্জন চায়ের তৃষ্ণাটি নিয়ে সুধাময়ের ঘরে যায়। বিছানায় পা তুলে আরাম করে বসে। মায়া কোথায়? সুরঞ্জনের প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন না। কিরণময়ী জানালার সামনে উদাস বসেছিলেন, তিনি কোনও বাক্য খরচ না করে রান্নাঘরের দিকে উঠে যান। সুধাময় কড়িকাঠের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়েছিলেন, তিনি চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। কেউ সম্ভবত প্রয়োজন বোধ করছে না খবরটি তাকে জানাতে। সে বোঝে সে ঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তার যা করা উচিত ছিল, বাড়ির সবাইকে নিয়ে কোথাও পালানো, সেটি সে সম্ভব করতে পারছে না। অথবা তার সম্ভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মায়ার সঙ্গে জাহাঙ্গীর নামের এক যুবকের প্রেম, সুরঞ্জন খবর পেয়েছে। মায়া নিশ্চয়ই এই ছেলের সঙ্গে চান্স পেলেই ডেটিং-এ যাবে। ঘর থেকে বেরিয়েছে যখন, তখন আর ভাবনা কী! দাঙ্গা বাঁধলে হিন্দুরা কেমন আছে, কী করছে এসব খবর নেওয়া মুসলমানদের এক ধরনের ফ্যাশন। এই ফ্যাশন নিশ্চয়ই জাহাঙ্গীরও করবে। আর মায়া ধন্য হবে। মায়া যদি ধন্য হতে হতে একসময় বিয়েই করে ফেলে জাহাঙ্গীরকে! মায়ার দু ক্লাস ওপরে পড়ে ছেলেটি। সুরঞ্জন আশঙ্কা করে জাহাঙ্গীর মায়াকে শেষ অবধি বিয়ে করবে না। সুরঞ্জন তার নিজের জীবন দিয়ে বোঝে, পারভিনের সঙ্গে বিয়ে হয় হয় করেও তার হয়নি। পারভিন বলেছিল, তুমি মুসলমান হও। সুরঞ্জন বলেছিল, ধর্ম পাল্টানোর প্রয়োজন কী, তার চেয়ে যার যা ধর্ম তাই থাকুক। যার যা ধর্ম তাই থাকবে প্রস্তাবটি পারভিনের পরিবারের মনঃপুত হয়নি। তাঁরা একটি মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে পারভিনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেও কেঁদে-কেঁদে বিয়ের পিঁড়িতে বসল।
সুরঞ্জন উদাস চোখে চেয়ে থাকে একচিলতে বারান্দার দিকে। ভাড়া বাড়ি, উঠোন নেই, মাটি নেই খালি পায়ে হাঁটবার দৌড়োবার। কিরণময়ী চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে যেন কিছুই হয়নি সুরঞ্জন বলে—ডিসেম্বর চলে এল, অথচ শীত তেমন পড়েনি, ছোটবেলায় শীরের ভোরে খেজুরের রস খেতাম।
কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন—ভাড়া বাড়ি, খেজুরের রস কোথায় পাবি। নিজের হাতে লাগানো সব গাছ-গাছালির বাড়ি তো জলের দরে বিক্রি করে এলাম।
সুরঞ্জন চায়ে চুমুক দেয় আর তার মনে পড়ে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনত গাছ কাটার লোক। মায়া আর সে নীচে দাঁড়িয়ে থিরথির কাঁপত। কথা বললে মুখ থেকে সাদা ধোঁয়া বের হত। সেই খেলে বেড়ানো মাঠা, সেই আম জাম কাঁঠাক পেয়ারা সুপুরি নারকেলের বাগান আজ কোথায়! সুধাময় বলতেন—এ হচ্ছে তোর পূর্বপুরুষের ভিটে, এই ভিটে ছেড়ে কখনও কোথাও যাবি না।
শেষ পর্যন্ত বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সুধাময় দত্ত। মায়ার যখন ছ’বছর বয়স, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একবার সে হারিয়ে যায়। শহরের কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যায়নি, চেনা কারও বাড়িতেও নয়। সে এক টেনশনের ব্যাপার ছিল বটে। সুরঞ্জন অনুমান করেছিল এডওয়ার্ড স্কুলের গেটে আড্ডা দেয় কিছু ছেলে, পকেটে ছোরা থাকে, ওরাই মায়াকে তুলে নিয়ে গেছে। দু দিন পর মায়া ঘরে ফিরে এসেছে। একা। কোত্থেকে এসেছে, কারা ধরে নিয়েছিল কিছু বলতে পারেনি। পুরো দু মাস সে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে উঠত। মানুষ দেখলে ভয় পেত। রাতে রাতে ঢিল পড়ত বাড়িতে, উড়ো চিঠি আসে মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে তারা, বাঁচতে চাইলে টাকা দিতে হবে তাদের। সুধাময় জি ডি এন্ট্রি করতে থানায় গিয়েছিলেন। থানার পুলিশ এন্ট্রি খাতায় নাম-ধাম টুকে রাখল, ব্যস আর কিছু নয়। ছেলেরা বাড়িতে ঢুকে গাছের ফল পেড়ে নিয়ে যায়, সবজির বাগান মাড়িয়ে যায়, বাগানের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলতে পারে না। পাড়ার ক’জনের কাছে সমস্যাটি পেড়েও কোনও লাভ হয়নি। তাঁরা বলেছেন, আমরা কী করতে পারি বলুন! এরকমই চলে আসছিল, অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সুরঞ্জন তার ক’জন বন্ধু নিয়ে ওদের সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল। সামাল দেওয়া হয়ত যেত, সুধাময় রাজি হননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে যাবেন। বাড়ি বিক্রি করবেন। বাড়ি বিক্রি করবার আরও এক কারণ ছিল, এটি নিয়ে মামলা চলছিল দীর্ঘদিন। পাশের বাড়ির শওকত আলী জাল দলিল করে বাড়ির দখল নিতে চেষ্টা করছিলেন। এসব ঠেকাতে কোর্ট-কাছারি করতে করতে সুধাময় বড় বিরক্ত ছিলেন, বড় ক্লান্ত। সুরঞ্জন বাড়ি বিক্রির পক্ষে ছিল না। সে তখন কলেজে পড়া তাজা যুবক। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কলেজ সংসদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতেছে। সে ইচ্ছে করলে ওই বদমাশ ছোকরাদের পেটাতে পারত। কিন্তু সুধাময়ই অস্থির হয়ে গেলেন বাড়ি বিক্রি করতে। তিনি আর এ শহরে থাকবেন না, ঢাকায় চলে যাবেন। এ শহরে প্র্যাকটিসও নাকি ভাল জমছে না, স্বদেশি বাজারের ফার্মেসিতে বিকেলে বসে থাকেন, রোগী নেইম দু-চারটে যা রোগী আসে, হিন্দু, দরিদ্র, এত দরিদ্র যে পয়সা নিতে ইচ্ছে করে না। সুধাময়ের অস্থিরতা দেখে সুরঞ্জনও আর চাপাচাপি করেনি। এখনও মনে পড়ে দু বিঘা জমির ওপর তাদের সেই বিশাল বাড়িটির কথা। যেদিন দশ লাখ টাকার বাড়িটি রইসউদ্দিন সাহেবের কাছে মাত্র দু লাখ টাকায় বিক্রি করে দিলেন সুধাময়, কিরণময়ীকে বললেন—চল চল তৈরী হও, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদেছিলেন কিরণময়ী। সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয়নি সত্যিই বাড়িটি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে। জন্ম থেকে চেনা ঘরদুয়োর ছেড়ে, শৈশবের খেলার মাঠ ছেড়ে, ব্রহ্মপুত্র ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে তার চলে যেতে ইচ্ছে করেনি। যে মায়ার জন্য যাওয়া সেই মায়াই যেতে চায়নি, সে ঘাড় নেড়ে বলেছে—‘আমি সুফিয়াকে ছেড়ে যাব না।’ সুফিয়া তার স্কুলের বন্ধু। কাছেই বাড়ি। বিকেলে উঠোনে বসে দুজনে পুতুল খেলে, হাঁড়ি পাতিল খেলে। সেও মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল। সুধাময় মানলেন না। যদিও শেকড়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই ছিল বেশি। তিনিই বললেন—জীবন আর ক’দিনের, ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত বাস করতে চাই।
নিশ্চিন্ত বাস কি কোথাও সম্ভব? সুরঞ্জন জানে সম্ভব নয়। যে ঢাকায় এসে সুধাময় হাঁফ ছেড়েছিলেন, সেই ঢাকায়, একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী শহরে সুধাময়কে ধুতি ছেড়ে পাজামা পরতে হয়েছে। সুরঞ্জন টের পেয়েছে পিতার যন্ত্রণা, তিনি মুখ ফুটে বলেননি কিছু, তবু তো তাঁর দীর্ঘশ্বাস বাড়ির দেওয়ালগুলোতে আঘাত খেত, বুঝত সব সুরঞ্জন। সামনে তাদের দেওয়াল ছিলই একটি, এত চেয়েছে অতিক্রম করতে, কেউই পারেনি। না সুধাময়, না সুরঞ্জন।
সুরঞ্জন বারান্দায় রোদের দিকে মগ্ন চোখে তাকিয়েছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা একটি মিছিলের শব্দ তাকে সজাগ করে। মিছিলটি কাছে আসতেই সুরঞ্জন শুনতে চেষ্টা করে কী বলে মিছিলে, সুধাময় আর কিরণময়ীও কান পেতে থাকেন। সুরঞ্জন লক্ষ্য করে কিরণময়ী উঠে জানালা বন্ধ করে দেন। জানালা বন্ধ করলেও মিছিলটি যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পার হয় তখন স্পষ্ট শোনা যায় মিছিলের শ্লোগান—‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ সুরঞ্জন লক্ষ্য করে সুধাময় কেঁপে উঠলেন। কিরণময়ী স্থির দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধ জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। সুরঞ্জনের মনে পড়ে নব্বইয়েও এই শ্লোগান দিয়েছিল ওরা, ওরা হিন্দুদের নাস্তা করতে চায়, তার মানে খেয়ে ফেলতে চায়। সুরঞ্জনকে এই মুহূর্তে হাতের কাছে পেলে ওরা খেয়ে ফেলবে। কারা এরা, পাড়ার ছেলেপুলেরাই তো! জব্বার, রমজান, আলমগীর, কবীর, আবেদিন এরাই তো। এরা বন্ধুর মত, ছোট ভাইয়ের মত, সকাল বিকেল কথা হচ্ছে, পাড়ার সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। দল বেঁধে সমাধানও হচ্ছে। এরা আজ সাতই ডিসেম্বরের চমৎকার শীতের সকালে সুরঞ্জনকে নাস্তা করবে!


সুধাময় ঢাকা এসে তাঁতিবাজারে উঠেছিলেন। তাঁর মামাতো দাদার বাড়ি ছিল তাঁতিবাজার। অসিত রঞ্জনই ছোট একটি বাড়ি দেখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—সুধাময়, তুমি বড়লোকের ছেলে। তুমি কি থাকতে পারবে ভাড়া বাড়িতে?

সুধাময় বলেছিলেন—কেন পারব না? আর মানুষ থাকছে না?

—তা থাকছে। কিন্তু তুমি তো জন্ম থেকে কোনও অভাব দেখনি। আর নিজের বাড়ি বিক্রি করলেই বা কেন? মায়া ছোট মানুষ। ও তো আর যুবতী মেয়ে ছিল না। নিশ্চয়ই সে ধরনের কোনও ঘটনা ঘটত না। আমাদের উৎপলাকে তো পাঠিয়েই দিলাম কলকাতায়। ও তো কলেজে যেতে পারত না। ওকে তুলে নেবে, ধরে নেবে এসব বলত পাড়ার ছেলেরাই। ভয়ে পাঠিয়ে দিলাম। এখন তিলজলায় ওর মামার বাড়িতে আছে। মেয়ে বড় হলে বড় দুশ্চিন্তা হয় দাদা।

অসিত রঞ্জনের কথাকে উড়িয়ে দিতে পারেন না। সুধাময়। হ্যাঁ দুশ্চিন্তা হয় বৈকি। তিনি ভাবতে চান মুসলমানের মেয়ে বড় হলেও তো দুশ্চিন্তা হয়। সুধাময়ের এক ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে শাড়ি টেনে খুলেছিল একদল যুবক, মেয়েটি তো হিন্দু ছিল না, ছিল মুসলমান। যুবকরাও মুসলমান ছিল, তবে? সুধাময় নিজেকে সান্ত্বনা দেন আসলে হিন্দু মুসলমান নয়, দুর্বল পেলে সবলেরা অত্যাচার কিছু করবেই। নারী দুর্বল বলে সবল পুরুষেরা অত্যাচার করছে। অসিত রঞ্জন তাঁর দুই মেয়েকেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সা ভাল রোজগার করেন, সোনার দোকান আছে ইসলামপুরে, নিজেদের দোতলা একটি বাড়ি আছে পুরনো, এটির সংস্কারও করেননি তিনি। নতুন বাড়ি করবেন, তাতে উৎসাহ নেই কোনও। সুধাময়কে একদিন বললেন—টাকাপয়সা খরচ কোর না। দাদা। জমাও। বাড়ি বিক্রির টাকা পারো তো পাঠিয়ে দাও, আমার আত্মীয়রা আছে ওখানে, জমি-টমি রেখে দেবে।

সুধাময় জিজ্ঞেস করেছেন–ওখানে মানে?

অসিত রঞ্জন গলা খাটো করে বলেছেন—কলকাতায়। আমিও কিনে রেখেছি।

সুধাময় গলা উঁচু করে বলেছেন—তুমি এখানে টাকা কামাবে। আর খরচা করবে গিয়ে ওদেশে? রীতিমত দেশদ্রোহী বলা যায় তোমাকে।

অসিত রঞ্জন অবাক হতেন। সুধাময়ের কথায়। ভাবতেন কোনও হিন্দুর মুখে এ ধরনের কথা তিনি তো শোনেননি। বরং টাকা পয়সা এখানে যথেচ্ছ খরচ না করে জমিয়ে রাখবার পক্ষপাতী সকলে। কখন কী হয় বলা তো যায় না। এখানে গেড়ে বসব, আর কখন কারা খুঁটি তুলে আছাড় মারে, বলা যায়?

সুধাময় মাঝে মধ্যে ভাবেন কেন তিনি ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে এলেন। নিজের বাড়ির মায়া তাঁকে এতটুকু কাতর করল না কেন? মায়াকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, হতেই পারে। অপহরণের ঝামেলায় হিন্দু মুসলমান দু সম্প্রদায়ই ভুগতে পারে। সুধাময় নিজের বাড়িতে কি নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন? নিজের কাছেই গোপনে জিজ্ঞেস করেন তিনি। তাঁতিবাজারের অপরিসর ঘর বারান্দায় শুয়ে বসে সুধাময় ভাবেন; কেন তিনি নিজের ভিটে ছেড়ে অচেনা একটি এলাকায় বাস করছেন। এ কি নিজেকে লুকোনো? কেন নিজের ভিটে মাটি নিয়েও উদ্বাস্তু মনে হত নিজেকে? নাকি শওকত সাহেবের জাল দলিলের মামলায় সুধাময়ের সন্দেহ হত তিনি হেরে যাবেন? নিজের বাড়ির মামলায় নিজের হারা। তার চেয়ে মান-সম্মান নিয়ে চলে যাওয়াই ভাল। সুধাময় তাঁর এক খুড়তুতো দাদাকে দেখেছেন নিজের বাড়ি খোয়াতে। বাড়ি ছিল টাঙাইলের আকুর টাকুর পাড়ায়। এক হাত জমির দখল নিতে চায় পাশের বাড়ির জমির মুন্সি। আদালতে মামলা উঠল, পাঁচ বছর পর্যন্ত মামলা গড়িয়ে গড়িয়ে জমির মুন্সির পক্ষ নিল। তারাপদ ঘোষাল দেশের পাট, চুকিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে। ইন্ডিয়া। শওকত সাহেবের মামলাটিরও তারাপদের দশা হয় কি না ভেবেই তিনি কি নিজের বাপ ঠাকুরদার বাড়িটি নিমেষে বিক্রি করে দিলেন? হবে হয়ত। এও কথা ঠিক, আগের সেই দাপট ছিল না। সুধাময়ের। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। ফাঁক পেলেই চলে যেত এক-একটি হিন্দু ফ্যামিলি। অনেকে মরে গেলেন। ক’দিন পর পরই চেনা পরিচিতদের বা আত্মীয় বন্ধুদের লাশ কাঁধে নিয়ে ‘হরি বোল বলো হরি’ বলতে হয়েছে। যাঁরা বেঁচে হিলেন, ছিলেন চরম হতাশা নিয়ে। যেন কোনও মূল্য নেই বেঁচে থাকায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সুধাময় লক্ষ করতেন, তিনিও ভয় পাচ্ছেন, যেন খুব শিগরি গভীর রাত্তিরে একটি দৈত্য এসে তাঁদের গুড়িয়ে দেবে। সকলের স্বপ্নের দেশ ইন্ডিয়া, গোপনে ফন্দি আঁটেন বডাির পার হবার। সুধাময় শুনে অনেকদিন বলেছেন—‘দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হল, কাপুরুষের মত পালালে ইন্ডিয়া। দেশ স্বাধীন হল তো বীরদৰ্পে ফিরে এলে। এখন কথায় কথায় এ ওকে টোকা মারল তো চলে যাবে ইন্ডিয়া, যতসব কাওয়ার্ডের দল।’ সুধাময়ের সামনে যতীন দেবনাথ, তুষার কর, খগেশ কিরণ সকলেই ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি করে নিলেন। তাঁরা মুখ ফুটে মনের কথা বলতে আর রাজি হন না। সুধাময় নিজের শহরে নিজে বড় একা হয়ে গেলেন। বন্ধু শাকুর, ফয়সল, মজিদ, গাফফারদের সঙ্গে দূরত্বও স্পষ্ট হচ্ছিল। হয়ত গেলেন ওঁদের বাড়িতে, বলে বসলেন—’তুমি একটু সামনের ঘরে বস, সুধাময়, নামাজটা সেরে আসি, অথবা ‘আজ এলে, আজ তো বাড়িতে মিলাদ। বামপন্থীদের বয়স বাড়ে আর তাঁরা ধর্মে মনোযোগী হন, সুধাময় বড় নিঃসঙ্গ বোধ করেন। নিজের শহরে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেকের এই দৈন্য তাঁকে আহত করে খুব, তিনি তাই পালাতে চাইলেন, দেশ থেকে নয়, স্বপ্নের শহরটি ছেড়ে, যেন তাঁকে আর হাঙরের মত গিলে না খেতে পারে স্বপ্নের নীল নিকষ মৃত্যু।

সুরঞ্জন প্রথম প্রথম চেঁচামেচি করত নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কবুতরের খোপে বাস করতে হচ্ছে বলে। তারপর তারও সয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, বন্ধু-বান্ধব গড়ে উঠেছে নতুন করে, ভাল লাগা এখানেও জন্মেছে। এখানেও রাজনীতিতে জড়িয়েছে সে। এখানেও মিটিং মিছিলে সুরঞ্জনের ডাক পড়ে। কিরণময়ী আপত্তি করেছিলেন, এখনও আপত্তি করেন, রাতে রাতে চোখের জল ফেলেন নিজের হাতে লাগানো সিমের ম্যাচটি কী আর আছে, আমাদের পেয়ারার মত অত বড় পেয়ারা পাড়ায় আর একটি ছিল না, আহা ডাবগাছগুলোর কী অবস্থা কে জানে, গোড়ায় কি ওরা লবণজল দেয়! কেবল কি কিরণময়ীর, সুধাময়েরও কি কষ্ট কম হয়।

ঢাকায় বদলি হয়ে সুধাময় ভেবেছিলেন প্রমোশনের ব্যাপারে খোঁজখবর কিছু করা যাবে। গিয়েও ছিলেন মিনিস্ট্রিতে, গিয়ে বসে থাকতে হয় ছোটখাটো কেরানির রুমে, বড়জোর এ পি এস-এর রুমে। ‘ভাই, ফাইলটার কি কিছু হবে? এসবের সদুত্তর কখনও মিলত না। হচ্ছে হবে জাতীয় কিছু শব্দ শুনে সুধাময়কে বিদায় নিতে হত। কেউ কেউ বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু, মেয়ের আমাশা ওষুধ লিখে দিন, বুকের বাঁদিকটা ক’দিন থেকে ব্যথা করছে, ভাল ওষুধ দিন তো। * সুধাময় ব্রিফকেস খুলে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা প্রেসক্রিপশান প্যাড বের করতেন, তারপর গোটা গোটা অক্ষরে ওষুধের নাম লিখে দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার কাজটি হবে তো ফরিদাসাহেব?’ ফরিদাসাহেব একগাল হেসে বলতেন, ‘এসব কি, আর আমাদের হাতে মশাই? সুধাময় খবর পেতেন তাঁর জুনিয়ারদের প্রমােশন হচ্ছে। তাঁর ফাইলের ওপর চোখের সামনে ডাঃ করিমুদ্দিন, ডাঃ ইয়াকুব মোল্লার ফাইল পড়ল, ওঁরা এসোসিয়েট প্রফেসার-এর পোস্টিং নিয়ে কাজও শুরু করে দিলেন। সুধাময়ের জুতের সুখতলি কেবল খরচা হতেই লাগল। ওঁরা বললেন, ‘আজ নয় কাল আসুন, আপনার ফাইল সেক্রেটারির কাছে যাবে। কাল নয়। পরশু আসুন, আজ মিটিং আছে। মন্ত্রী দেশের বাইরে গেছেন, এক মাস পর আসুন’—এসব শুনতে শুনতে সুধাময় একদিন বুঝলেন তাঁর আসলে হবে না। দেড়-দু বছর পদোন্নতির পেছনে ছুটে তো দেখলেন যারা ডিঙিয়ে যাবার তারা যায়, যোগ্যতা না থাকলেও যায়। রিটায়ারমেন্টের সময় চলে আসছে, তাঁর প্রাপ্য ছিল এ সময় এসোসিয়েট প্রফেসারের পদটি, তিনি কোনও লোভ করেননি, এ তাঁর প্রাপ্য, জুনিয়ররা এই পদ নিয়ে মাথার ওপর বসে আছে।

শেষ পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক হিসেবেই অবসর গ্রহণ করলেন সুধাময় দত্ত। একইসঙ্গে চাকরি করতেন মাধব চন্দ্ৰ পাল, সুধাময়ের ফেয়ারওয়েলের দিন গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘মুসলমানের দেশে নিজের জন্য খুব বেশি সুযোগ-সুবিধে আশা করা ঠিক নয়। যা পাচ্ছি তাই আমাদের জন্য বেশি।’ বলেই তিনি ঠা-ঠা করে হেসেছিলেন। তিনিও দিব্যি সহকারীর চাকরি করে যাচ্ছেন, দু-একবার তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল পদোন্নতির জন্য, আর সব নাম নিয়ে আপত্তি না উঠলেও এই নামটি নিয়ে উঠেছে, তা ছাড়া মাধব চন্দ্রের আরও দোষ ছিল, তিনি নাকি সোভিয়েত ঘুরে এসেছেন। সুধাময় পরে ভেবেছিলেন মাধব চন্দ্র ভুল বলেননি, প্রশাসন, পুলিশ, কিংবা সেনাবাহিনীর উঁচু পদে হিন্দুদের নিয়োগ বা পদোন্নতির ব্যাপারে বাংলাদেশের আইনের কোনও বাধা নেই। কিন্তু দেখা যায় মন্ত্রণালয়গুলোয় কোনও সেক্রেটারি বা এডিশনাল সেক্রেটারি পদে কোনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন তিনজন, আর হাতে গোনা ক’জন আছেন ডেপুটি সেক্রেটারি। সুধাময়ের বিশ্বাস সেই গুটিকয় জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ডেপুটি সেক্রেটারি নিশ্চয় পদোন্নতির আশা করেন না। ছয়জন মাত্র হিন্দু ডি সি আছেন। সারাদেশে। হাইকোর্টে হিন্দু জজ মাত্র একজন। পুলিশের নীচু পদে হয়ত তাদের নেওয়া হয়। কিন্তু এস পি পদে হিন্দু ক’জন আছেন? সুধাময় ভাবেন তিনি আজ সুধাময় দত্ত বলেই তাঁর এসোসিয়েট প্রফেসর হওয়া হয়নি। তিনি যদি মোহাম্মদ আলি অথবা সলিমুল্লাহ চৌধুরি হতেন তবে নিশ্চয় এই বাধা থাকত না। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলেও মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, বিশেষত শিল্পঋণ সংস্থা থেকে শিল্পকারখানা গড়বার জন্য ঋণ দেওয়াও হয় না।


সুধাময় দত্ত তাঁতিবাজারেই আবার নিজের বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। জন্মের শহর ছেড়েও তাঁর মায়া যায়নি, দেশের মায়া। বলতেন, ‘ময়মনসিংহই কি দেশ? পুরো বাংলাদেশই তো আমার দেশ।’

কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ব, দুটো সবজির গাছ লাগাব, ছেলেমেয়েরা গাছের ফল খাবে, এগুলো এখন স্বপ্নের মত, এখন মাস মাস ভাড়ী শুনতেই দেখি সব যায়।’ রাত গভীর হয়ে এলে কিরণময়ী প্রায়ই বলতেন, ‘বাড়ি বিক্রির টাকা আর রিটায়ার করার পর মোটা অঙ্কের টাকাই তো পেলে, চল চলে যাই, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন তো কম নেই আর!’

সুধাময় বলতেন—আত্মীয়রা একবেলা তোমাকে খাওয়াবে ভেবেছ? ভাবিছ উঠবে তাঁর বাড়িতে, গিয়ে দেখলে মুখ ফিরিয়ে রাখল, বলল কোথায় উঠলেন, চা-টা খাবেন কি না।

–নিজেদের টাকা পয়সা নিলে অন্যের কাছে হাতই বা পাততে হবে কেন?

–আমি যাব না। তোমরা যেতে চাইলে যাও। নিজের ভিটে ছেড়েছি, তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব? সুধাময় চেচিয়েই বলতেন।

তাঁতিবাজার ছেড়ে আরমানিটোলা, ওখানে ছ’বছর থেকেছেন, এরপর প্রায় সাত বছরের মত টিকাটুলিতে আছেন সুধাময় দত্ত। এর মধ্যে হৃদপিণ্ডে অসুখ জমেছে। গোপীবাগের এক ওষুধের দোকানে বিকেলে বসবার কথা ছিল, সেখানে নিয়মিত বসা হচ্ছে না। বাড়িতেই রোগী আসে, বাইরের ঘরে রোগী দেখবার টেবিল পাতা আছে। চৌকিও আছে একদিকে। একপাশে বেতের সােফা পাতা। বুকসেলফে বইপত্র বিস্তর। ডাক্তারি, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি গাদাগাদি করে এক কাতারেই দাঁড় করানো। সুধাময় ওঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটান, সন্ধেবেলা স্যান্ডেলের চটাস চটাস শব্দ তুলে নিশীথবাৰু আসেন, আখতারুজ্জামান, শহিদুল ইসলাম, হরিপদ প্রায়ই আসেন। দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা গড়ায়। কিরণময়ী ওঁদের চা করে দেন। চিনি ছাড়া চাই দিতে হয় বেশি। বয়স হয়ে গেছে। সবারই। সুধাময়েরও কী কম হল!

মিছিলের শব্দ শুনে চকিতে উঠে বসেন সুধাময়। সুরঞ্জনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, কিরণময়ীর কবুতরের মত নরম বুকখানা দ্রুত ওঠা-নমা করছে। ভয়ে, ক্ৰোধে। সুধাময়েরও কি কিছু আশঙ্কা হয় না? কিছু ক্ৰোধ কি তাঁরও হওয়া উচিত নয়?

Tags – Lojja, Bangla Golpo, lajja

Share This Article