Bangla Kobita Abritti (বাংলার সেরা আবৃতির কবিতা)

Bongconnection Original Published
22 Min Read



Bangla Kobita Abritti (বাংলার সেরা আবৃতির কবিতা)

Bangla Kobita Abritti (বাংলার সেরা আবৃতির কবিতা)
Loading...

Bangla Kobita Abritti Lyrics

Loading...



           যে কথা বলিতে চাই
                      – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যে-কথা বলিতে চাই,
 বলা হয় নাই,
 সে কেবল এই–
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
 দেখিনু সহস্রবার
 দুয়ারে আমার।
 অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
 সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
 আমি নাহি জানি।

শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
 নদীর এপারে ঢালু তটে
 চাষি করিতেছে চাষ;
 উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
 চলে কি না চলে
 ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
 আধো-জাগা নয়নের মতো।
 পথখানি বাঁকা
 বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
 নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।

ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
 ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
 নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
 যেখানে বসায় মেলা– এই সব ছবি
 কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
 এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
 ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
 অকস্মাৎ নদীস্রোতে
 ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
 হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।





            কান্ডারী হুঁশিয়ার
                  – কাজী নজরুল ইসলাম

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!

         সর্বহারা
          – কাজী নজরুল ইসলাম

ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
 চোরাবালির চর,
 ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
 সেই চরে তোর ঘর?
 শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
 হাট তুলে দে সর্বহারা,
 মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা
 ঝ’রছে মাথার’ পর,
 দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
 দুলিয়ে তর”-কর।

 কন্যারা তোর বন্যাধারায়
 কাঁদছে উতরোল,
 ডাক দিয়েছে তাদের আজি
 সাগর-মায়ের কোল।
 নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
 পাল তু’লে তুই দে রে আজি
 তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
 তরঙ্গে খায় দোল।
 নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
 মায়ার নোঙর তোল্।

 ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
 যায় রে বেলা যায়।
 মাঝি রে! দেখ্ কুরঙ্গী তোর
 কূলের পানে চায়।
 যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
 ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
 মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
 ঘুমুস্ নে আর, হায়!
 ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
 এতই কি রে দায়?

 হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
 চাস্নি ত সাত ক্রোর,
 একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
 ভরা অভাব তোর,
 চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
 একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
 একটি প্রদীপ-আলো-করা
 একটু-কুটীর-দোর।
 আস্ল মৃত্যু আস্ল জরা,
 আস্ল সিঁদেল-চোর।

 মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
 মাটির বুকে চল্!
 শক্তমাটির ঘায়ে হউক
 রক্ত পদতল।
 প্রলয়-পথিক চ’ল্বি ফিরি
 দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
 হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
 নাচছে সিন্ধুজল।
 চল্ রে জলের যাত্রী এবার
 মাটির বুকে চল্ ।

        বাংলাদেশ
               – কাজী নজরুল ইসলাম

নমঃ নমঃ নমঃ বাঙলাদেশ মম
চির-মনোরম চির-মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর।
শিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী
আশিস্-মেঘবারি সদা তার পড়ে ঝরি,
যেন উমার চেয়ে এ আদরিনী মেয়ে.
ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ চিকুর ।
গ্রীষ্মে নাচে বামা কাল-বোশেখী ঝড়ে,
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,
শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে
গাহিয়া আগমনী গীতি বিধুর।
 হরিত অঞ্চল হেমন্তে দুলায়ে
ফেরে সে মাঠে মাঠে শিশির-ভেজা পায়ে,
শীতের অলস বেলা পাতা ঝরার খেলা
ফাগুনে পরে সাজ ফুল-বধূর।
এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে
যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,
এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে
ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর।


              মানুষ
               – কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
 মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্‌ ।
 নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
 সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
 ‘পূজারী দুয়ার খোলো,
 ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’
 স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
 দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!
 জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
 ডাকিল পান’, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’
 সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
 তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!
 ভুখারী ফুকারি’ কয়,
 ‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
 মসজিদে কাল শির্‌নী আছিল,-অঢেল গোস–র”টি
 বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি,
 এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্‌
 বলে, ‘ বাবা, আমি ভূখা-ফাকা আমি আজ নিয়ে সাত দিন!’
 তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
 ভূখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
 ভূখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা
 সোজা পথ দেখ!’ গোস–র”টি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
 ভুখারী ফিরিয়া চলে,
 চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু।
তব মস্‌জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুর”ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
কোথা চেঙ্গিস্‌, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
 হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
 মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন’ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন’;-গ্রন’ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে
 আমাতে মহামহিম।

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবা-রাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উ”চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন’ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!
ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
 চাষা ব’লে কর ঘৃণা!
দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।
 সে মার রহিল জমা-
কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!

বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্‌খানে!
 তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’।

              ঈশ্বর
                – কাজী নজরুল ইসলাম

কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।
শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদের ক’রো না ক’ বীর, ভয়-
তাহারা খোদার খোদ্‌ ‘ প্রাইভেট সেক্রেটারী’ ত নয়!
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি!
রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কুলে-
রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’।
উহারা রত্ন-বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!
ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।

Bangla Kobita Abritti Nazul Islam


             দুঃশাসনের রক্ত পান
                   – কাজী নজরুল ইসলাম

বল রে বন্য হিংস্র বীর,
 দুঃশাসনের চাই রুধির।
 চাই রুধির রক্ত চাই,
 ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই
 দুঃশাসনের রক্ত চাই!
 দুঃশাসনের রক্ত চাই!!

 অত্যাচারী সে দুঃশাসন
 চাই খুন তার চাই শাসন,
 হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি
 ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি।
 আয় ভীম আয় হিংস্র বীর,
 কর অ-কণ্ঠ পান রুধির।
 ওরে এ যে সেই দুঃশাসন
 দিল শত বীরে নির্বাসন,
 কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত
 করেছে রে এই ক্রূর স্যাঙাত।
 মা-বোনেদের হরেছে লাজ
 দিনের আলোকে এই পিশাচ।
 বুক ফেটে চোখে জল আসে,
 তারে ক্ষমা করা? ভীরুতা সে!
 হিংসাশী মোরা মাংসাশী,
 ভণ্ডামি ভালবাসাবাসি!
 শত্রুরে পেলে নিকটে ভাই
 কাঁচা কলিজাটা চিবিয়ে খাই!
 মারি লাথি তার মড়া মুখে,
 তাতা-থৈ নাচি ভীম সুখে।

 নহি মোরা ভীরু সংসারী,
 বাঁধি না আমরা ঘরবাড়ি।
 দিয়াছি তোদের ঘরের সুখ,
 আঘাতের তরে মোদের বুক।
 যাহাদের তরে মোরা চাঁড়াল
 তাহারাই আজি পাড়িছে গা’ল!
 তাহাদের তরে সন্ধ্যা-দীপ.
 আমাদের আন্দামান-দ্বীপ!
 তাহাদের তরে প্রিয়ার বুক
 আমাদের তরে ভীম চাবুক।
 তাহাদের ভালবাসাবাসি,
 আমাদের তরে নীল ফাঁসি।
 বরিছে তাদের বাজিয়া শাঁখ,
 মোদের মরণে নিনাদে ঢাক।

 জীবনের ভোগ শুধু ওদের,
 তরুণ বয়সে মরা মোদের।
 কার তরে ওরে কার তরে
 সৈনিক মোরা পচি মরে?
 কার তরে পশু সেজেছি আজ,
 অকাতরে বুক পেতে নি বাজ।
 ধর্মাধর্ম কেন যে নাই
 আমাদের, তাহা কে বোঝে ভাই?
 কেন বিদ্রোহী সব-কিছুর?
 সব মায়া কেন করেছি দূর?
 কারে ক’স মন সে-ব্যথা তোর?
 যার তরে চুরি বলে চোর।
 যার তরে মাখি গায়ে কাদা,
 সেই হয় এসে পথে বাধা।

 ভয় নাই গৃহী! কোরো না ভয়,
 সুখ আমাদের লক্ষ্য নয়।
 বিরূপাক্ষ যে মোরা ধাতার,
 আমাদের তরে ক্লেশ-পাথার।
 কাড়ি না তোদের অন্ন-গ্রাস,
 তোমাদের ঘরে হানি না ত্রাস;
 জালিমের মোরা ফেলাই লাশ,
 রাজ-রাজড়ার সর্বনাশ!
 ধর্ম-চিন্তা মোদের নয়,
 আমাদের নাই মৃত্যু-ভয়!
 মৃত্যুকে ভয় করে যারা,
 ধর্মধ্বজ হোক তারা।
 শুধু মানবের শুভ লাগি
 সৈনিক যত দুখভাগী।
 ধার্মিক! দোষ নিয়ো না তার,
 কোরবানির১ সে, নয় রোজার২ !
 তোমাদের তরে মুক্ত দেশ,
 মোদের প্রাপ্য তোদের শ্লেষ।

 জানি জানি ঐ রণাঙ্গন
 হবে যবে মোর মৃৎ-কাফন৩
 ফেলিবে কি ছোট একটি শ্বাস?
 তিক্ত হবে কি মুখের গ্রাস?
 কিছুকাল পরে হাড্‌ডি মোর
 পিষে যাবি ভাই জুতিতে তোর!
 এই যারা আজ ধর্মহীন
 চিনে শুধু খুন আর সঙিন;
 তাহাদের মনে পড়িবে কার
 ঘরে পড়ে যারা খেয়েছে মার?
 ঘরে বসে নিস স্বর্গ-লোক,
 মেরে মরে তারে দিস দোজখ৪!
 ভয়ে-ভীরু ওরে ধর্মবীর!
 আমরা হিংস্র চাই রুধির!
 শহতান মোরা? আচ্ছা, তাই।
 আমাদের পথে এসো না ভাই।

 মোদের রক্ত-রুধির-রথ,
 মোদের জাহান্নামের পথ,
 ছেড়ে দেও ভাই জ্ঞান-প্রবীণ,
 আমরা কাফের ধর্মহীন!
 এর চেয়ে বেশি কি দেবে গা’ল?
 আমরা পিশাচ খুন-মাতাল।
 চালাও তোমার ধর্ম-রথ,
 মোদের কাঁটার রক্ত-পথ।
 আমরা বলিব সর্বদাই
 দুঃশাসনের রক্ত চাই!!

 চাই না ধর্ম, চাই না কাম,
 চাই না মোক্ষ, সব হারাম
 আমাদের কাছে: শুধু হালাল৫
 দুশমন-খুন লাল-সে-লাল

আরো পড়ুন, Munmun Mukherjee Kobita 

       শুধু তোমাদের জন্য
                – নির্মলেন্দু গুণ

কতবার যে আমি তোমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে
 গুটিয়ে নিয়েছি হাত- সে কথা ঈশ্বর জানেন।
 তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে
 কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
 সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
 তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
 দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
 আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবে:
 এই ওঠো,
 আমি, আমি।
 আর অমি এ-কী শুনলাম
 এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
 কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
 কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
 আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
 আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
 আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
 তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
 আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।




           দিনমজুরের কাব্য
                   – নির্মলেন্দু গুণ

মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা,
আকাশে মেঘের সাথে সূর্যের
জমেছে মধুর খেলা।
ভাঙতে ভাঙতে বিজন মাঠের
কুয়াশা গিয়েছে কেটে,
কখন শুকনো মাটির তৃষ্ণা
শিশির খেয়েছে চেটে।
অতটা খেয়াল রাখেনি কৃষক
মগ্ন ছিল সে কাজে,
হঠাৎ পুলক পবনে হৃদয়
পুষ্পিত হলো লাজে।
ফিরিয়া দেখিল বধূটি তাহার
পেছনে আলের ’পরে
বসে আছে যেন ফুটে আছে ফুল
গোপনে চুপটি ক’রে।
সামনে মাটির লাল সানকিটি
জরির আঁচলে বাঁধা,
আজ নিশ্চয় মরিচে-রসুনে
বেনুন হয়েছে রাঁধা।
হাসিয়া কৃষক মরাল বাঁশের
মুগুর ফেলিয়া দিয়া
কামুক আঁখির নিবিড় বাঁধনে
বাঁধিল বধূর হিয়া।
বরুন গাছের তরুণ ছায়ায়
দু’জনে সারিল ভোজ,
বধূর ভিতরে কৃষক তখন
পাইল মনের খোঁজ।
মেঘ দিল ছায়া, বনসঙ্গমে
পুরিল বধূর আশা;
মনে যাই থাক, মুখে সে বলিল:
‘মরগে’ বর্গা চাষা।’
শব্দটি তার বক্ষে বিঁধিল
ঠিক বর্শার মতো।
‘এই জমিটুকু আমার হইলে
কার কিবা ক্ষতি হতো?’
কাতর কণ্ঠে বধূটি শুধালো:
‘আইছ্যা ফুলির বাপ,
আমাগো একটু জমিন হবে না?
জমিন চাওয়া কি পাপ?’
‘খোদার জমিন ধনীর দখলে
গেছে আইনের জোরে,
আমাগো জমিন অইব যেদিন
আইনের চাকা ঘোরে।’
অসহায় বধূ জানে না নিয়ম
কানুন কাহারে বলে;
স্বামীর কথায় চোখ দু’টি তার
সূর্যের মতো জ্বলে।
‘বলদে ঘোরায় গাড়ির চাক্কা,
নারীর চাক্কা স্বামী;
আইনের চাকা আমারে দেখাও
সে-চাকা ঘুরামু আমি।’
কৃষক তখন রুদ্র বধূর
জড়ায় চরণ দু’টি
পা-তো নয় যেন অন্ধের হাতে
লঙরখানার রুটি।
যতটা আঘাত সয়ে মৃত্তিকা
উর্বরা হয় ঘায়ে-,
ততটা আঘাত সইল না তার
বধূর কোমল পায়ে।
পা দু’টি সরিয়ে বধূটি কহিল:
‘কর কী, কর কী? ছাড়ো,
মানষে দেখলি জমি তো দেবি না,
দুন্যাম দেবি আরও।’
পরম সোহাগে কৃষক তখন
বধূর অধর চুমি,
হাসিয়া কহিল: ‘ভূমিহীন কই?
আমার জমিন তুমি।’
আকাশে তখনও সূর্যের সাথে
মেঘেরা করিছে খেলা,
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা।

   


         আমি যদি হতাম
                  – জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফালগুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।




              লোকেন বোসের জার্নাল
                             – জীবনানন্দ দাশ

সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি-
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।

পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
নাড়বো না আমি
নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই- অমিতা বলছি যাকে-
কিন্তু কথাটা থাক;
কিন্তু তবুও-
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো- তবে
এখন কি করে মন কারভান হবে।

প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
কখন সময় হবে।

হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে-
হৃদয় কেন যে কাঁপে,
‘ভালোবাসতাম’- স্মৃতি-অঙ্গার – পাপে
তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায়- সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে
এর উত্তর হবে?

সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে- সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

       

     

             আসবার আসিব ফিরে
                         – জীবনানন্দ দাশ

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙায়;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়- রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে-

 Tags – Bangla Kobita, Bengali Poem, Kobita Abritti

Share This Article