❤️একজন রিক্সাওয়ালার অসাধারণ গল্প।❤️
****************************************
রিক্সা চালাই। বিয়ে করেছিলাম আজ থেকে এক বছর আগে। আমার মতই এক গরীবের মেয়েকে বউ করে এনেছিলাম আমি।
অভাবের সংসারটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছিলো ও। বুঝতে পারি বউ আমায় খুব ভালোবাসে। আমি যখন রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফিরি, ও আমার স্নানের জন্য জল তুলে দেয়। মাঝে মাঝে আমিও অবশ্য তুলে দেই। বাড়িতে কারেন্ট নেই, খেতে বসলে ও পাখা দিয়ে হাওয়া করে। গরমের রাতে দুজনে অদল বদল করে পাখা দিয়ে হাওয়া করি, ভবিষ্যৎটাকে সাজানোর গল্প করি দুজনে। গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম বুঝতে পারতামনা। রিক্সায় বড়বড় সাহেবরা তাদের বউকে নিয়ে উঠতো। দুজনে মিলে অনেক গল্প করতো। সাহেবদের কাছে শুনতাম তারা যেদিন বিয়ে করেছে সেদিন আসলে তারা নাকি অনুষ্ঠান, পার্টি না কি জানি করে। এই সব আমার জানা নেই। যখন শুনতাম আমারো ইচ্ছা করতো বউকে একটা শাড়ী কিনে দিতে। বউকে যে খুব ভালোবাসি আমি। কিন্তু পারিনা। অভাবের সংসার, দিন আনি দিন খাই। তাই একটা মাটির ব্যাংক কিনেছিলাম। ওটাতে রোজ দু’চার টাকা করে ফেলতাম। দেখতে দেখতে অভাবের সংসারে আজ একটা বছর হয়েগেল। আজ সকালে রিক্সা নিয়ে বের হবার আগে বউ যখন রান্না ঘরে গেল তখন বউকে না জানিয়ে লুকিয়ে রাখা মাটির ব্যাংকটা বের করে ভেঙ্গে দেখলাম সেখানে প্রায় ৪৮০ টাকা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বউকে বলেছিলাম, আজ বাড়িতে ফিরতে দেরি হবে। বউ মাথা নাড়ে, বলে ভালো করে যাবে।চলে গেলাম রিক্সা নিয়ে। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় মার্কেটে গিয়েছিলাম বউয়ের জন্যে একটা শাড়ী কেনার জন্য। আজরাতে বউকে দেবো। ঘুরে ঘুরে অনেক শাড়ীই দেখছিলাম, পছন্দ হয় কিন্তু দামের জন্য বলতে পারি না। অবশেষে দোকানদারকে বললাম,
— ভাই এই কাপড়টার দাম কত?
— ১৫০০ টাকা।
আমার কাছে তো আছে মাএ ৪৮০ টাকা। তাই ফিরে আসলাম। মার্কেট থেকে বের হয়ে বাইরে বসে থাকা দোকানদারদের থেকে ৪৮০ টাকায় একটা শাড়ী কিনে নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই দোকান গুলো যদি না থাকতো, তাহলে কত কষ্ট হতো আমাদের মত গরিবদের। ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে ঢুকলাম। অনেকদিন পর বউকে কিছু একটা দিতে পারবো, ভাবতেই বুকটা খুশিতে ভরে উঠছে বারবার। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পরার ভান করে শুয়ে আছি। ববারোটা বাজার অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে আছি। কল্পনার জগতে ভাসছিলাম, বউকে দেবার পর বউ কি বলবে? কতটা খুশি হবে?
রাত বারোটা বেজে গেল। বউকে ডেকে তুললাম। ডেকে তুলে বউয়ের হাতে শাড়ীটা তুলে দিয়ে বললাম, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আজকের তারিখে তুমি আমার এই কুড়ে ঘরটাতে এসেছিলে। আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য এই ছোট্ট উপহার। বউ শাড়ীটা বুকে জড়িয়ে ধরে আর চোখ দিয়ে তার জল ঝরতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে ট্রাংটা খুলে শাড়ীটা রেখে দেয়। তারপর কি যেন বের করে। আমি উকি মেরে দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি। বউ ট্রাংটা বন্ধ করে আমার হাতে একটা প্যান্ট দিলো। কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম আমি। কারন টাকা পেলো কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম,
— টাকা পেলে কোথায় তুমি?
— অনেক দিন আগে থেকে প্রত্যেকদিন একমুঠো করে চাল খাবারের চাল থেকে আলাদা করে জমিয়ে রাখতাম। জমিয়ে জমিয়ে কিছুদিন আগে পাশের বাড়ির বৌদির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে প্যান্ট কিনেছি। ভাবছিলাম আজকে দেবো, তুমি তো এসেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরলে। তাই ঠিক করেছিলাম কাল সকালে দেবো।
আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু প্যান্টটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। তারপর বললাম, শুনেছি বড়ো সাহেবরা নাকি বিয়ের দিন তারিখে কেক কাটে। বউ বলে, আমাদের কি এতো টাকা আছে?
— বাড়িতে মুড়ি আছে।
— আছে।
— যাও সরিষা তেল দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে এসো। সাথে একটা কাঁচ লঙ্কা আর একটা পিঁয়াজ এনো।
— আচ্ছা দাঁড়াও আনছি।
টিনের ফাঁক আর জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। দুজন জানালার পাশে বসে মুড়ি খাচ্ছি, আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পালন করছি। ❤️
ছোট্ট ছোট্ট গিফট আর অফুরন্ত ভালোবাসায় বেঁচে থাকুক জীবন যোদ্ধা রিক্সাওয়ালাদের জীবন।