আবার আসিবো ফিরে – Bangla Premer Golpo Love Story- Valobashar Golpo

Bongconnection Original Published
11 Min Read

আবার আসিবো ফিরে - Bangla Premer Golpo Love Story- Valobashar Golpo
Loading...







– বাবা, ও বাবা শুনছেন, একটু শুনুন না!
বৌমা পৌলমীর ডাকে ঘুম ভেঙে যায় অনীশবাবুর। সত্যিই, দুপুরে খাওয়ার পর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। চোখ খুলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন ভদ্রলোক।
– কী হয়েছে বৌমা, কিছু দরকার? তোমার মায়ের ফোন এসেছে?
– না বাবা, মায়ের ফোন না…
– তাহলে কী হয়েছে মা? কিছু এনে দিতে হবে?
– না বাবা! আসলে আপনার ছেলে ফোন করেছিল, বললো, কাল ওদের অফিস ছুটি আছে, তাই ভাবছি দুজন মিলে ঘুরে আসি।
– হ্যাঁ বৌমা, সেতো খুব ভালো কথা। যাও ঘুরে আসো।
– হ্যাঁ বাবা, কাল ভোর ভোর বেড়োবো। রাতে ফিরবো। আপনি সাবধানে থাকবেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– আর হ্যাঁ, আমি এখন একটু বেরোচ্ছি। আপনি গেটে তালাটা দিয়ে এসে বসুন!
– হ্যাঁ, চলো যাচ্ছি।

 রাত্রিবেলা ছেলে ফিরলে, ছেলের সাথেও কথা হয় অনীশবাবুর।

 বিছানায় শুয়ে, অনীশবাবুর মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরতে থাকে। আচ্ছা, ওই বাড়িতে তো আশাও একাই আছে। ‘মিতালি-প্রবীরও’ তো ঘুরতে গেছে গতসপ্তাহে। ফিরবে আগামী সোমবার। এখনো তিন দিন বাকি। বেচারি আশুটা আমার একা একা ওতো বড় বাড়িতে আছে, ওর নিশ্চই খুব মন খারাপ করে, যতোই  কাজের লোক থাকুক না কেন! বাবুকে কতবার বলেছি, তোর মায়ের সাথে কতদিন দেখা হয় না, একদিন ঐ বাড়ি নিয়ে যাবি? বাবুর তো খুব কাজের চাপ, ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আচ্ছা, কাল ভোরে ওরা দুজন বেরিয়ে গেলে, যদি আমি এক ফাঁকে আশাকে গিয়ে দেখি আসি। প্রায় দুমাস আমাদের দেখা হয়নি। ফোনে বলছিল, ওর হাটুর ব্যথাটা বেড়েছে….

আসলে,অনীশবাবু অর্থাৎ শ্রী অনীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার স্ত্রী শ্রীমতি আশালতা ভট্টাচার্য একজন গৃহবধূ ছিলেন।তাদের দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবন। তাদের দুই সন্তান, মৈনাক আর মিতালী। তারা দুজনেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে  সুপ্রতিষ্ঠিত। ছেলেমেয়ে দুজনের বিয়েও দিয়েছেন। জামাই প্রবীর MNC তে কর্মরত। ছেলে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী।




নিজেদের সব কর্তব্য পালন করে, অবসরের পর বেশ কয়েকবছর একসঙ্গে থাকতে পারলেও, এখন আর অনীশবাবু ও আশাদেবী একসঙ্গে থাকেন না। আসলে, তারা দুজন আলাদা আলাদা ভাবে ছেলে-মেয়ের বাড়িতে থাকেন। মানে, ছয় মাস ছয় মাস করে। অনীশবাবু যে ছয়মাস মেয়ের বাড়িতে থাকেন, সেই ছয় মাস আশাদেবী ছেলের বাড়ি, এইভাবে প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর মানুষ আর বাড়ি দুইই পরিবর্তন হয়। প্রায় বছর দুই ধরে এইরকমটাই চলে আসছে। তাই দুজনের দেখা হয় না খুব একটা, খুব বেশি হলে বছরে চার থেকে পাঁচ বার। তাও একবেলা। তাই রোজ একটু কথা আর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য মোবাইল ফোনটাই ভরসা।

রাত্রিতে সব প্ল্যান করে রাখলেন ভদ্রলোক। একবার ভাবলেন, আশাকে ফোন করে বলবেন। ও খুব খুশি হবে। কিন্তু, পরে ভাবলেন, আগে জানাবেন না, একেবারে হাজির হয়েই চমকে দেবেন।

 ভোরে মৈনাকরা বেরিয়ে গেলেই, কলঘরে ঢুকলেন অনীশ বাবু। স্নান সেরে, আলমারি খুলে, ইস্ত্রী করা জামা কাপড়, সোয়েটার, চাদর আর প্রিয় আতর মেখে, ওষুধপত্র পকেটে পুরে, চারিদিক ভালো করে, দেখেশুনে তালা মেরে, মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। রাস্তায় ছানার জিলিপি কিনলেন স্ত্রীর জন্যে, আশার যে ছানার জিলিপি বড় পছন্দ। যথা সময়ে উপস্থিত হলেন বাড়ির সামনে।

 Calling bell টেপার কথা মাথায় ছিল না বোধহয়, তাই, দরজায় দাড়িয়ে, স্ত্রীর নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকেন অনীশবাবু। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। স্বামীর কন্ঠস্বর শুনে, হুড়মুড়িয়ে নীচে নেমে আসেন আশাদেবী। দুজনের আবার দেখা হয়,  অনেকদিন  পর। স্বামীকে দেখে ভীষণ খুশি আশালতা। কিছু কথার পর, নিজের হাতে বরের জন্যে চা করে দেন, তাছাড়াও দুপুরবেলা maid কে সরিয়ে, বরের জন্যে শুক্তো, ধোকার ডানলা আর দইরুই বানান আশাদেবী। বুকের ব্যথাটা খুব বেড়েছে, এখন মাঝে মাঝেই যন্ত্রনা হয়, পিঠেও খুব ব্যথা করে। “তাতে কী, তাই বলে কী স্বামীকে রান্না করে খাওয়াবোনা??? তা কী কখনো হয়???” রান্নার মেয়েটা অনেকবার করে মানা করলো, অনীশবাবুও বহুবার নিষেধ করেছেন, কিন্তু, কে শোনে কার কথা! স্বামীকে নিজের হাতে পরিবেশন করেও খাওয়ালেন আশাদেবী। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বাসন মেজে, মেয়েটা চলে গেলো, আবার সন্ধ্যেবেলায় আসবে।

ঘরে ফিরে আশাদেবী স্বামীকে শুধালেন, “কী গো, দুপুরের ওষুধগুলো সব সাথে এনেছ তো? তোমার তো দুপুরে খাওয়ার পর দুটো ওষুধ ছিলো, এনেছ??” অনীশবাবু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
– “আচ্ছা, আমারটা তো হলো, কিন্তু তোমার সব ওষুধ তুমি নিয়ম করে খাচ্ছ তো???” তোমার শরীরটা তো বেশ খারাপ। এ বাড়িতে আসার পর আর ডাক্তার দেখাও নি? তোমার তো ডাক্তার দেখানো উচিত ছিলো। তোমার এতো প্রেসার সুগার ওঠা-নামা করে।
– হ্যাঁ গো, প্রেসারটা মনে হয় একটু বেড়েছে, বুকটা খুব ধড়ফড় করে, আবার কোলেস্টেরলটাও বাড়তে পারে, জানি না। মেয়েটা ফিরুক,ওকে বলবো।
– তা এতোদিন বলোনি কেন?
– আরে বলবোখন, এখনো তো ওদের বাড়িতে তিনমাস আছি।
– চুপ করো, দেখেছো তো, কথা বলতে গিয়েই কেমন  হাপাচ্ছ! এখানে এসে বসোতো, ওষুধগুলো খাও, নিজের একটু যত্ন নিয়ো। স্নান করে চুলটাও তো, ঠিক করে আচড়াও নি। এসো, আজ আমি তোমার চুল আচড়ে দেই।
– থাক, অনেক হয়েছে। এই তুমি বাড়ি যাবে না? ওরা তো দুজনে বাড়ি ফিরে যাবে। তুমি তো খেতে বসে, টেবিলে ছেলেকে ফোনে মিথ্যা কথা বললে, বললে, বাড়িতেই আছো! ওরা ফিরে, গেটে তালা দেখে কী ভাববে বলো তো!!
– ধুর, ওদের ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আমি পাঁচটা নাগাদ এখান থেকে বেরোলে, সাড়ে সাতটা-আটটার মধ্যে বাড়ি পৌছে যাব। তুমি শুধু তোমার তনুকে বলে রেখো, ও যেন ‘মেয়ে-জামাইকে’ কিছু না বলে! বুঝলে!!!
– বুঝলুম, বুঝলুম, আমি খুব বুঝলুম!
– এবার আনো তো দেখি চিরুনি খান!
– উফ্ফ্ফ, আনছি।

অনীশবাবু পরমযত্নে স্ত্রীর চুল আচড়ে দিলেন। সিদূর কৌটো থেকে সিদূর নিয়ে, বেশ চওড়া করে, সিঁথিখানি রাঙিয়েও দিলেন। টিপটাই কেন বাদ যায়, তাই সেটাও নিজের হাতে…..

সবশেষে, আশালতা স্বামীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললেন, “কী গো তুমি আমায় আশীর্বাদ করবে না?”
– কী দরকার ছিল এসবের?
– হা গো, এটাই তো নিয়ম! তুমি জানো না?
– সব নিয়ম কানুন মানার দরকার আছে কী কোনো?
– না গো, শুধুই নিয়মের জন্যে নয় গো, আজ যে আমার বড় সাধও হলো….
অল্প হেসে, স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে অনীশ বাবু বললেন, “সৌভাগ্যবতী ভব!”

– তুমি আবার এরকম ভাবেই আর একদিন আসবে তো? আজ আমার খুব ভালো লাগলো গো! আবার একদিন আমার সাথে দেখা করতে আসবে তো?
– হ্যাঁ গো, আসবো! আমারও যে তোমায় দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। আমি আবার আসবো!

পরম আনন্দে, পরম প্রাপ্তির সুখে, আশাদেবীর চোখদুটো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুতেই আর চোখ খুলে রাখতে পারেন না, বার বার বুজে আসে। কিন্তু না, ঘুমালে তো চলবে না। তার তো এখনো অনেক কথা বলার আছে, অনেক কথা শোনার আছে, অনেক গল্প করা এখনও বাকি। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপর আবার কবে দেখা হবে, কে জানে…. !!!

স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে, অনীশবাবু সযত্নে স্ত্রীর মাথাটি নিজের কোলের উপর নিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বলতে থাকেন। পাশে সামান্য গুটিয়ে থাকা কম্বলটা বেশ টান টান করে শরীরের উপর বিছিয়ে দেন।

 না, এবার সত্যিই আশা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমিও একটু ঘুমাই। সবে তিনটে পাঁচ, পাঁচটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। চোখ বুজে আসে অনীশ বাবুর…..

ঘুম ভাঙে ‘calling bell’ এর শব্দে। জেগে ওঠে, অনীশবাবু দেখেন, সারা ঘর অন্ধকার। “এমা! এতো সন্ধ্যে হয়ে গেছে!!” পাশে হাত দিয়ে দেখলেন, আশা তখনো অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। বার কয়েক ডাকলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পেলেন না।

আবার ‘calling bell’ এর আওয়াজ। তাড়াতাড়ি করে দরজাটা খুলতে গেলেন অনীশবাবু। তনু এসেছে।

– কী কাকু, আজ থাকবেন এখানে?
– না রে মা, আমার কী থাকার উপায় আছে? তুই তো সব জানিস মা।
– কাকু, আপনাদের থাকার এই নিয়মটা কোনোভাবে  বদলানো যায় না? ছয়মাস করে আলাদা থাকার কী দরকার। দুইবাড়িতেই একসাথে ছয় মাস করে করে থাকতে পারেন তো। ধুর, কাকিমা কত কষ্ট পায়, আপনাকে ছাড়া থাকতে, আমি একবার দিদিকে বলেছিলাম, দিদি বললো, কী সব সিস্টেম-টিস্টেম না কী আছে!




– তুই ঠিক বলেছিস রে! আমি ঐ বাড়ি যাই, গিয়ে এই ব্যাপারে কথা বলবো। আমারও আর ভালো লাগে না।
– কাকু, কাকিমা কই? কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না তো!!!
– আরে মা, দেখ না, তোর কাকিমা এখনো ঘুমাচ্ছে।
– হ্যাঁ কাকু, কাকিমার শরীরটা কয়দিন ধরে খুব খারাপ। আমি বলি, তোমাদের ফোন করে জানাতে, কিছুতেই জানায় না। দিদি-জামাইবাবু রোজ নিয়ম করে ফোন করে, ওদেরও কিছু বলে না। সবসময় বলে, “ভালো আছি, ভালো আছি।” আমি কিছু বলতে গেলেই, আমায় ধমকে চুপ করিয়ে দেয়।
– হাঁ রে, তোর কাকিমাটা ঐরকমই, কোনোদিনই কিছু বলে না।

“আশা, আশা, এবার উঠে পড়ো। আজ যে আমায় যেতেই হবে, বাড়ির চাবিটা যে আমার কাছে আছে গো, ছেলে-মেয়ে দুটো যে ফিরে ঠান্ডায় বাইরে দাড়িয়ে থাকবে। আশু, ও আশু……”

কিন্তু, অনীশবাবু আর তনুর বারংবার ডাকেও আশালতা দেবীর ঘুম ভাঙে না। তনু ছুটে পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার এসে জানায়, “Heart Attack… Ashalata  Devi is no more…..”

বিশ্বাস হয় না অনীশ বাবুর। বারবার আকুল হয়ে ডাকতে থাকেন তার আশুকে। ভালো করে একবার দেখুন ডাক্তারবাবু, ওর মুখের হাসিটা, যার Heart Attack হয়, সে এমন ভাবে হাসতে পারে???

কিন্তু, সাড়া মেলে না। আশালতা দেবী তো তখন চিরনিদ্রায় শায়িত, আর তখনো তার ঠোঁটের কোণে পরম শান্তির হাসি…..

” আবার যদি ইচ্ছে করো
    আবার আসি ফিরে
দুঃখ-সুখের ঢেউ খেলানো
    এই সাগরের তীরে।


…………..

আবার তুমি ছদ্মবেশে,
    আমার সাথে খেলাও হেসে
নূতন প্রেমে ভালোবাসি
    আবার ধরণীরে। ” ❤

Share This Article