লাভ লেটার – Bangla Premer Golpo – Love Story in Bengali

Bongconnection Original Published
22 Min Read

লাভ লেটার - Bangla Premer Golpo - Love Story in Bengali

Loading...

                    লাভ_লেটার







 আপনারাই বলুন তো মশাই , প্রেম কি কাউকে বলে কয়ে আসে নাকি কারোর বয়স দেখে আসে ?! এবার সেই প্রেম যদি এসে আমার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দেয় আর যে মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে আমার মনে অনুরাগ জন্মায় , তাহলে এই দুটো জিনিস আমি উপেক্ষা করি কিভাবে ?!?  শীতকালে লেপের মধ্যে আপনার গরম করা শরীরে কেউ তার ঠান্ডা পা দিয়ে আপনার সুখনিদ্রার দফারফা করেছে ? তখন ঠিক কেমন ফিলিংস হয়েছে আপনার ?? হ্যাঁ মশাই , ঠিক এইরকম কিংবা হয়তো এর থেকেও বেশিমাত্রায় অনুভব আমি করেছিলাম ।

    আচ্ছা বেশ , গোড়া থেকেই না হয় শুরু করা যাক । তখন আমার বয়স আর কতই বা হবে ! ” #একগালে_চড়_মারলে_বিয়ে_হবে_না ” এই প্রবাদটাই তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো । তাই গান্ধীজির অহিংস নীতিকে ফলো করে আমরা ছোটোরা , বড়োদের থেকে এক গালে চড় খাওয়ার পর অসীম মনোবলে দ্বিতীয় গালটা বাড়িয়ে দিতাম । বিয়ে করার ইচ্ছে-টিচ্ছে ছিলো না , কিন্তু ভয় লাগতো সত্যিই যদি বিয়ে না হয় ! তা আমাদের এই অবস্থায় দেখা পেলাম সেই মহাপুরুষের , যাকে কেন্দ্র করে আজকের এই সম্পূর্ণ লেখাটা । সে যাই হোক , সেদিন সন্ধেবেলা সব ভাইবোনরা মিলে ঠাম্মির ঘরের বড়ো পালঙ্কে  গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছি আর অপেক্ষা করছি কখন ঠাম্মি এসে আমাদের সেই ‘জোলা আর সাত ভুতের গল্প’ শোনাবে । কিছুক্ষণ পর বড়ো ঘরের দরজাটা খুলে গেল আর কেমন যেন একটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হলো । এরপর একটা পায়ের আওয়াজ খুব ধীরে ধীরে আমাদের পালঙ্কের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । লাইট তো আগে থেকেই বন্ধ ছিলো , তাই এই ছোটোখাটো অনুভূতিগুলো আমাদের ভাইবোনদের শরীরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগাতে লাগলো । আমরা একে অপরের হাতে , পায়ে কিংবা কোমরে চিমটি কেটে জানান দিতে লাগলাম যে এবার ভূতের গল্প শুরু হতে চলেছে । কিন্তু মিনিট পাঁচেক কেটে গেলো , তবুও না তো ঠাম্মির খকখক করে কাশির শব্দ পেলাম আর না তো তার গলায় সেই “হরি হরি” শব্দ শুনতে পেলাম । হঠাৎ কোথা দিয়ে যেন একটা আওয়াজ পেলাম ” হাউ – মাউ – খাউ – মানুষের গন্ধ পাউ ” । গলাটা সম্পূর্ণ অচেনা ; না তো সেই গলা আগে কোনোদিনও শুনেছি আর না তো সেই গলার অধিকারী মানুষটিকে আগে দেখেছি । ব্যাস , বুঝে গেলাম ঘরে আমাদের ভূত ঢুকেছে । চুপ করে পড়েছিলাম বিছানায় , কারুর গলা থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না । চাদরের মধ্যে সেই হালকা শীতেও ভয়ে ঘেমে নেয়ে যেন একাকার হয়ে উঠেছিলাম । আমাদের মধ্যে যে বড়ো , সেই দাদা হঠাৎ ভুতের মন্ত্র জপ করতে শুরু করলো , ” ভূত আমার পুত , পেত্নী আমার ঝি , রাম লক্ষণ সাথেই আছে , করবি আমার কি ? “।  আমরা ছোটোরা তার সঙ্গে গলা মেলাতে লাগলাম । আমি গলা মেলাতে গিয়ে টের পেলাম যে , আমার গলা থেকে স্বাভাবিক স্বর বেরোচ্ছে না । কেমন যেন একটা কুঁইকুঁই শব্দ হচ্ছে । আমাদের লালি কুকুরটার যে তিনটে বাচ্চা হয়েছে , ঠিক সেই বাচ্চাগুলোর মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে আমার গলা দিয়ে । ভয়ের চোটে তো কেঁদেই ফেললাম । এত ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম যে কি বিকট আওয়াজ বেরিয়েছিলো আমার গলা দিয়ে , তা কেবল আমি আর সেই ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিসকলই জানে । আমি তো চিল্লিয়ে উঠেছিলাম , ” অ মা গো , তুমি কোথায় গো , ভুতে আমায় মেরে ফেললো গো ……. ভুত আমাকে লালি কুকুরের বাচ্চাটার মতো করে দিয়েছে গো ….. আমি কি করে ইস্কুলে যাবো এবার ………. আমি তোমার সব কথা শুনবো ……. পড়াশোনা মন দিয়ে করবো ……..শুধু ভূত কে বলো যাতে আমায় কুকুর না করে ……. ”       সত্যি বলতে ভূত-ও বোধহয় আমার এই আচমকা চিৎকারে হকচকিয়ে গিয়েছিলো । তাই মা আসার আগেই কে যেন ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো । আমরা তো সবাই চাদরের নিচে ঠক ঠক ঠক ঠক করে কাঁপছি । আমি যতটা না ভূতের ভয়ে কাঁপছি , তার দ্বিগুণ কাঁপছি কুকুর হয়ে যাওয়ার ভয়ে । আমি যদি কুকুর হয়ে যাই , তাহলে লিপস্টিক পরবো কি করে !?  বাবা যে নতুন টিপগুলো এনে দিয়েছিলো রথের মেলা থেকে , সেগুলোরই বা এখন কি হবে ?! আমার আর আজকে মায়ের হাতের পায়েস খাওয়া হলো না ! এবার মা-ও আমাকে লালিদের মতো রাস্তার ধারে খেতে দেবে আর আমি লেজ নাড়াতে নাড়াতে ছুটে আসবো খাবার খাওয়ার জন্য ! আমি আর কোনোদিনও কথা বলতে পারবো না !  এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিলো , নাক দিয়েও বইতে শুরু করেছিলো ততক্ষনে । কান্নার চোটে নাকের জল , চোখের জল কিছুটা ঢুকে গিয়েছিল মুখের মধ্যে । কেমন যেন একটা নোনতা নোনতা স্বাদ লেগেছিলো । সে যাই হোক , কে যেন আমাদের ওপর থেকে চাদরটা আলতো করে সরিয়ে নিলো । দেখবো না , দেখবো না করেও চোখ খুলতেই দেখলাম একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে   । নাহ্ , ঠিক লোক বলা চলে না । বড় দাদার চেয়ে হয়তো কয়েকবছরের বড়ো । মুখখানা অনেকটা ঠিক সেই রামকৃষ্ণের মতো । ততক্ষণে এটা বুঝে গিয়েছিলাম যে এই ব্যাটাই আমাদের ভয় দেখিয়েছে । আর সত্যি বলতে যে কি ভীষণ রাগ হচ্ছিলো ব্যাটার ওপর , যে কি বলবো ! ইসস্ , আমি কি না স্কুলে সব বন্ধুদের মধ্যে সবথেকে বেশি সাহসী বলে পরিচিত আর সেই আমি কিনা বাড়িতে ভূতের ভয়ে  চিল-চিৎকার জুড়লাম ! ততক্ষণে বাড়ির বাকি কয়েকজন সদস্য , মানে আমার মাতৃদেবী , ঠাম্মি , কাকিমনি , জ্যেঠিমনি , বিন্দুমাসি (কয়েকবার এনার আচারের কৌটো থেকে আচার চুরি করেও খেয়ে নিয়েছি আমরা ভাই-বোনেরা ) , গোপালদাদা ( এনার একখানা নতুন ধুতি হারিয়ে গিয়েছিলো , কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না , আসলে আমরা ভাইবোনেরা এনার ধুতিখানা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ডাক্তার ডাক্তার খেলছিলাম । ডাক্তারের সাদা জামা , গ্লাভস্ , ফেট্টী , তুলো কোথায় পেতাম ওসব ; যাইহোক এসব কথা এখন মনে না করাই ভালো ) ।



ভাগ্যিস সেই মূহূর্তে আমার পিতৃদেব , কাকান আর জ্যেঠান বাড়ি ছিলো না ;  তাহলে ওদের সামনে তো আমি লজ্জায় মরে যেতাম ।  সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার পর বুঝতে পারলাম , রামকৃষ্ণের মতো দাড়িগোঁফ ওয়ালা লোক ওরফে দাদার নাম অতীনকান্তি মুখুজ্জে । ইনি নাকি আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় । কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসেছেন , তাই আমাদের বাড়িতে থাকবেন । তা মশাই থাকুন না বাপু , কে বারণটা করেছে শুনি !  কিন্তু তা বলে আমাদের সাহসিকতার এরকম পরিচয় নেওয়ার দরকার টা কি !?  সেদিন রাতে ঠাম্মির বুকের কাছে ঘেঁষে ফিসফিস করে বললাম , ” ও বুড়ি , এ ব্যাটা আমাদের বাড়িতে ক’দিন থাকবে গো ? “।  বুড়ির বোধহয় ঘুম ধরেছিলো , তাই বিড়বিড় করে কি বললো আর শুনতে পেলুম না । কয়েকদিন যেতে না যেতেই শুনতে পেলাম ওই মুখুজ্জে ব্যাটা নাকি আমাদের সব ভাই বোনদের গৃহশিক্ষক রূপে বহাল হইয়াছে । কি জ্বালা ! কি জ্বালা ! এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া ! একে তো সেদিনকার পর থেকে লজ্জায় সবার সামনে মুখ দেখাতে পারি না । যদিও বা বুক ঠুকে বলতে যাই যে , আমি পারবো , আমার সাহস আছে ; অমনি সবাই সে রাতের কথা তুলে ঠিক এমন পরিমান হাসাহাসি করে যে তাতেই আমার সব সাহস পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় ।  তারপরে না কি আমাদের আবার পড়াবে ! এমনিতেই তো পড়াশোনা জিনিসটার ওপর ছোটবেলা থেকেই একটা মোহ-হীনতা রয়েছে আমার । এরপর জানতে পারলাম এই মুখুজ্জে ব্যাটা নাকি এমবিবিএস করতে চায় । মানে টানে অতো বুঝতাম না সেই বয়সে ।  তাই মুখুজ্জে ব্যাটাকে ক্ষেপানোর জন্য সব ভাই-বোনেরা একটা স্লোগান মুখস্ত করে নিয়েছিলাম , 

             ” এমবিবিএস মুখুজ্জে ব্যাটা

               অংক কষে পাঁচশো প্যাটা  “

( আসল শব্দ #পাতা , শুধু স্লোগানের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা ওটাকে #প্যাটা বানিয়ে নিয়েছিলাম ) ।

        যাইহোক সকাল-সন্ধ্যে করলার রস গেলার মতো মুখ করে মুখুজ্জে ব্যাটার কাছে পড়তে বসতাম । প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো এই ভেবে যে , ব্যাটা প্রথম দিনই আমায় ভয় খাইয়ে দিয়েছিলো । কিন্তু ধীরে ধীরে সেই মুখুজ্জে ব্যাটাই আমার অতি পছন্দের ( হয়তো ভালোবাসার ) অতনু-দা হয়ে উঠেছিলো । সবথেকে বেশি আকর্ষণ করতো রামকৃষ্ণের মত মুখখানা , এর ওপর দারুন ভূতের গল্প বলার প্রবণতা , মাঝেমাঝে আচার , ঝাল মুড়ি এসবের জোগান দেওয়া কিংবা বাড়ির লোকজনদের খুব লুকিয়ে থিয়েটারে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া — এসবের ফাঁকেই অতনু-দা যে কিভাবে বাড়ির সব থেকে দজ্জাল বাচ্চা মেয়েটার খুব কাছের একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলো , সেটা হয়তো অতনু-দা নিজেও বুঝতে পারেনি । সেদিন দুপুরে ঠাম্মির সঙ্গে “প্রেম আমার” সিনেমা টা দেখার পর বুঝতে পারলাম , আমারও উচিত নিজে থেকেই অতনু-দাকে বলে দেওয়া যে আমি ওকে ভালোবাসি । কারন বলা তো যায় না , পরে যদি বলার সময় না পাই ! আর ওকে এটাও বলে দেবো আমি আর ওও খুব লুকিয়ে পালাবো যাতে বাবা , কাকান আমাদের ধরে ফেলতে না পারে ।   সেই মতো বাকি ভাই-বোনদের সঙ্গে প্ল্যান করে একখানা চিঠি লিখতে বসলাম । দাদা আমায় সাহায্য করতে বসলো । ছোটো বোনের প্রেম বলে কথা । দাদার কত দায়িত্ব , তাই না ! প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর একটা মোটামুটি মানের প্রেম পত্র লিখে তৈরি হলাম । বুকের মধ্যে অদ্ভুত রকম ঢিপঢিপ করছে । আচ্ছা অতনু-দা আবার বাবা – জ্যেঠুনকে বলে দেবে না তো ! চিঠিটা নিয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম অতনু-দার ঘরের দিকে । ঘরের দরজা খুলে দেখেছিলাম , অতনু-দা একমনে টেবিলে বসে পড়াশোনা করছে । আমি প্রথমে ভাবলাম , থাক , ফিরে যাই না হয় । কিন্তু পিছন ফিরে দেখি বাকি ভাই বোন গুলো এক বুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য । কি আর করি , ভাই বোনেদের কাছে নিজের সম্মানটা তো সবার আগে বাঁচাতে হবে , তাই না ?! সেই ভেবে “জয় বজরংবলী” বলে এগিয়ে গেলাম অতনু-দার পড়ার টেবিলের দিকে । তারপর চিঠিখানা অতনু-দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম , ” এটা তোমার জন্য , আর খবরদার , বাড়ির বড়োরা যেন কেউ জানতে না পারে । লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে দেখো আর কবে পালাবে সেটা বলে রেখো । ”    এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে , দ্বিতীয়বারের জন্য আর পিছনে না ফিরে এক ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম ঘরের বাইরে । আমার সাঙ্গ-পাঙ্গরা তখন অপেক্ষা করছিলো যে আমার সাথে কি হলো সেটা শোনার জন্য । ওদের বললাম , ” কয়েকদিন অপেক্ষা কর , নিজেরাই দেখতে পাবি ” বলে ঘুমাতে চলে গেলাম সবাই মিলে । আমার কিন্তু সে রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি । কি জানি , অতনু-দা আবার ভিলেন হয়ে যাবে না তো !

       পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর খুব ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করেছি । কে জানে বাড়ির লোক আমার প্রেম নিয়ে কিছু জানে না তো ! কিংবা সেই চিঠি খানা ! দুপুর কেটে গেলো , বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যেও এসে গেলো , কিন্তু না , পরিবেশ শান্ত । যেন কিছুই হয়নি কোথাও । আমারও বেশ ভালো লাগলো , যাক বাবা , অতনু-দা বিশ্বাসঘাতকতা করেনি ।  কিন্তু কখন পালাবে কিংবা কোথায় অপেক্ষা করবে , সেসব তো কিছুই বললো না । ধুস বাবা , ভালো লাগে না !! সন্ধ্যেবেলা মায়ের হাতের পিঠে-পুলি খেয়ে ঠাম্মির গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম । তারপর হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলাম , ” ও বুড়ি , অতনু-দাকে দেখছি না তো ! কোথায় গেছে ? ”   ঠাম্মি বললো , ” দুদিন আগে একখানা চিঠি এসেছিলো । ওর বাবার নাকি খুব শরীর খারাপ , তাই বেচারা বাড়ি গেলো । দেখি কবে আসে আবার ! ”  আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । এবার কি হবে , নায়ক-ই তো নেই , আমি একা নায়িকা কি করবো !

         দিন যায় , দিন আসে , আবার দিন যায় । কিন্তু আমার প্রথম ভালবাসার মানুষ অতনু-দা আর আসেনি তারপর থেকে আমাদের বাড়ি । অনেক অপেক্ষা করতাম , মাঝেমাঝে পিওনকাকু এলে সবার প্রথমে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম , ” আমার জন্য কোনো চিঠি এসেছে গো ” ,  কিন্তু প্রত্যেকবারই নিরাশ হতাম ।

     

            তখন কলেজে উঠেছি , নতুন বন্ধু বান্ধব আর ক্রাশ তো অসংখ্য ।  টুকিটাকি প্রপোজাল পাচ্ছি , তাদের মধ্যে কাউকে ভালো লাগছে কিন্তু কাউকেই #হ্যাঁ বলিনি । ধুর , সবকটাকেই কেমন যেন গায়ে পড়া , গায়ে পড়া মনে হতো ।  যাইহোক , বিন্দাস লাগছিলো কলেজ লাইফটা । সেদিন কলেজে কি যেন একটা অনুষ্ঠান ছিলো , বাড়িতে দেখে গিয়েছিলাম চিলি চিকেন হচ্ছে । তাই শুধু শুধু আর কলেজে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিলাম । বাড়িতে ফিরে , ফ্রেশ হয়ে , ডাইনিং হলে ঢুকতেই এক মস্ত চমক । টেবিলের ওপর আমার অতি পছন্দের ডেয়ারি মিল্ক সিল্কের একখানা প্যাকেট রয়েছে । আমি যতটা না অবাক , তার থেকেও বেশি খুশি হয়ে প্যাকেটটা নিয়েই বিনা অনুমতিতে ছিঁড়ে একটা টুকরো মুখে দিলাম । তারপর স্বর্গসুখ অনুভব করতে করতে মাকে জিজ্ঞেস করলাম , ” ও মা , কে আনলো গো এটা ? উমমম্ , অপূর্ব … অনবদ্য ……… ”       মা-ও দেখি মুচকি হেসে বললো , ” আচ্ছা তনু , এক কাজ কর তো , দোতলার বড়ো ঘরে তোর জন্য একটা উপহার আছে , সেটা দেখে আয় । ”   আমি তো নাচতে নাচতে , খেতে খেতে চললাম দোতলার দিকে । কি জানি কি উপহার এনেছে ! খুব আনন্দ হচ্ছে আজ । তাড়াতাড়ি দোতলার দরজাটা খুলতেই দেখলাম ভেতরটা অন্ধকার । হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে সুইচবোর্ডটা পেয়ে গেলাম আর লাইটটা জ্বালাতেই যেন একরাশ অতীত ঝাঁপিয়ে পরলো আমার চারিদিকে । বিছানার ওপর হাসিমুখে বসে আছে সেই মুখুজ্জে ব্যাটা । দাড়ি গোঁফ আগের থেকে বেশ বড়ো হয়েছে । গায়ের রংটা একটু তামাটে । আর মুখে একগাল হাসি । সেই শান্ত দু’চোখে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে । আমার হাত দিয়ে ক্যাডবেরিটা আরেকটু হলেই নিচে পড়ে যাচ্ছিলো । কোনোমতে নিজেকে সামলে অবাক স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম , ” অতনু-দা তুমি এখানে ? কবে এলে ? কেমন আছো ? তোমার বাবা ঠিক আছে ? ”     অতনু-দা আলতো হেসে বললো , ” হ্যাঁরে তনু , এই আছি আর কি ! তুই কেমন আছিস বল ? বেশ বড়ো হয়ে গেছিস তো আর ……….. “

 —  ” আর কি অতনু-দা ?? “

— ” এইই …… একটু সুন্দরীও হয়ে গেছিস বোধহয়”

—  ”  ধ্যাত , কি যে বলোনা “

  তারপর কি একটা মনে পড়াতে আমার কানের পাতাটা গরম হয়ে উঠলো । হাতের ক্যাডবেরিটা দুম করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম , ” যাও , তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলবো না । যাওয়ার দিন তো একবারও বলে গেলে না , এখন আবার ঢং ! “

 অতনু-দা এবার খানিক লাজুক ভঙ্গিতে বললো , ”  নারে তনু , বিশ্বাস কর , বলে যেতে চেয়েছিলাম । কিন্তু হাতে সময় ছিল না রে । তুইই বল , বাবা ছাড়া আমার আর কেউ নেই । সেই লোকটাই যদি অসুস্থ হয়ে যায় , তাহলে আমি কাকে নিয়ে থাকবো ? সেদিন সকালে বেরোনোর আগে তাই তোর মুখখানা দেখে গিয়েছিলাম । আর কিছু চেয়েও হয়তো বলতে পারিনি …… “

     জানিনা কেন এত বছর পর এই দজ্জাল মেয়েটার ভিতরেও অদ্ভুত এক ভাঙ্গন ধরছে । চোখের কোল দুটো ব্যথা ব্যথা করছে , নাকটা জ্বালা করছে । অতনু-দা কাছে এসে মাথায় হাত বোলাতে আর শক্ত থাকতে পারলাম না । ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম ।

— ” খুব বাজে তুমি অতনু-দা , খুব বাজে । একটুও ভালোবাসো না আমায় , তাই না । “

   অতনু-দা মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্তিমিত স্বরে বলে চললো , ” হুশ পাগলী , তোর জন্য একখানা টেডিবিয়ার এনেছি , ঠিক তোর মাপের , দেখবি না ? “

  আমি অতনু-দাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছি । এত বছর পরেও আমার কান্নার ভঙ্গিমাটা আর পাল্টালো না । আমার চোখের জল , নাকের জল এসে লেপটে গেছে অতনু-দার বুকের জামায় । আমি ওকে জড়িয়ে ধরেই বললাম , ” দরকার নেই কোনো টেডিবিয়ারের । আমার জ্যান্ত টেডিবিয়ারটার বুকে মাথা রেখেই আমি খুশি । “

    অতনু-দা হঠাৎ কানের পাশে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো , “এই তনু , পালাবি আজ আমার সঙ্গে ? আজ সারাটা দিন আমরা পালিয়ে বেড়াবো এই শহরটার থেকে , এই শহরের মানুষগুলোর থেকে , আজ আমরা নিজেদের থেকে পালাবো , পালাবি ?! “

    আমি সেই মুহূর্তেও কাঁদতে কাঁদতেই বললাম , ”  আচ্ছা বেশ , পালাবো , তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে কিন্তু । “




—  ” কেন বলতো ? “

—  ” জানো না বুঝি , আজ বাড়িতে চিলি চিকেন হচ্ছে ! “

—  ” ও হ্যাঁ , ভুলেই গিয়েছিলাম । বিরিয়ানিও হচ্ছে , গন্ধ পেয়েছি । ঠিক আছে , ঠিক আছে , তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসবো আমরা । “

—  ” তুমি এখানে দাঁড়াও , আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি । এইভাবে বের হলে লোকে আমায় পেত্নী ছাড়া আর কিছুই ভাববে না । “

— ” তুই সুন্দরী ছিলিস কবে যে নতুন করে পেত্নী হবি ?? “

—  ” ভালো হয়েছে যাও তো “

—  ” আচ্ছা তনু শোন্ , তোকে কিছু একটা দেখানোর ছিলো …. “

—  ” কি দেখাবে তাড়াতাড়ি দেখাও  “

—  ” চোখ বন্ধ কর্ “

—  ” উমমম্ ……. এবার দেখাও “

— ” নে চোখ খোল “

চোখ খুলতেই আবার একটা ধাক্কা , বিস্ময়-মেশানো । অতনু-দার হাতে ধরা একখানা চিঠি । প্রায় হলুদ হয়ে আসা চিঠির বুকের লেখাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে জ্বলজ্বল করছে । কাঁপা কাঁপা আঙুলে চিঠিটা ছুঁয়ে দেখলাম  ।

—  ” কিরে কিছু মনে পড়ছে ?  “

—  ”  তুমি এটা এখনো তোমার কাছে রেখে দিয়েছো , অতনু-দা !!  “

—  ” আমার প্রিয় মানুষটার কোনো স্মৃতি আমার কাছে রাখবো না , এটা তুই ভাবলে কি করে ? “

—  ”  আমি তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা “

—  ”  আচ্ছা বাবা , আমি তোকে সব মনে করিয়ে দেবো । এখন তুই যা তো , তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় । আমি সেই দামাল-দস্যি মেয়েটাকে আবার দেখতে চাইছি । “

—  ” তুমি দাঁড়াও অতনু-দা , আমি এক্ষুনি আসছি তৈরি হয়ে “

     ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগালাম । বা-হাতে চিঠিখানা ধরা । চিঠিটা উড়ছে , হাওয়ায় উড়ছে । কিন্তু আমার হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে পালাতে পারছে না । আজ পালাবো , আমি আর অতনু-দা আজকের দিনটার মতো পালিয়ে যাবো দুজনে ; হয়তো আমাদের নিজেদের থেকে । আর আমাদের দুজনের এই পালানোর সাক্ষী থাকবে হলুদ হয়ে আসা চিঠিখানা ।।


        

Share This Article