ভালোবাসার তিক্ততা – Valobashar Golpo – Bengali Love Story

Bongconnection Original Published
9 Min Read



ভালোবাসার তিক্ততা - Valobashar Golpo - Bengali Love Story
Loading...







“শৈ.. শৈল্পী, আমার মনে হয় আমি তোকে ভালবাসি।”

শুভ্র আচমকা কোত্থেকে যেন ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল। ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ওকে হাঁফাতে দেখে ধারণা করলাম দীর্ঘ রাস্তা দৌড়ে পেরিয়েছে সে। যেহেতু একটা বাক্য ই উচ্চারণ করেছে আসার পর, তাহলে ধরে নেয়া যায় সেটা বলার উদ্দেশ্যেই তার আসা। হাহ! আজ থেকে কয়েকটা মাস আগে হলেও কথাটা শোনার পর অতিরিক্ত খুশীতে জ্ঞান হারাতাম আমি। চেঁচিয়ে চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানান দিতাম, সে আমাকে ভালবাসে! সে আমার অনুভূতি একই আবেগে ফিরিয়ে দিচ্ছে। কারণ শুভ্রর মুখ থেকে এই একটা কথা শোনার জন্য মনে মনে কত আশা আর কল্পনা করেছিলাম আমি এতগুলো বছর ধরে! অথচ কথাটা শোনার পর আজ নিজের ভেতর বিরক্তি ছাড়া কোন অনুভূতি ই টের পেলাম না কেন যেন! মনে হলো, বাকি সব অনুভূতি বুঝি ফুরিয়ে গেছে! ফুরিয়ে যাওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক। সবকিছুর তো শেষ আর সীমা আছে। তাই না? আর আপনার অনুভূতি যত শক্তিশালী আর সীমাছাড়া ই হোক, অবহেলা এবং এড়িয়ে যাওয়া – এই দুটো পাপ কীর্তি সেই অনুভূতি অবশ করে দিবেই। এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রমাণ যে আমি!
আমি খুব অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে ওর চোখের দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম ওর চোখে চোখ রাখলে হয়তবা পুরোনো “আমি” কিছুটা ফিরে আসবে। আবার অনুভব করতে পারব। কিন্তু না। নিজের নির্লিপ্ততায় অবাক হয়ে বললাম,
“ও, আচ্ছা।”
তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে উঠে চলে এলাম। একদম সোজা গাড়িতে উঠে সোজা বাড়ি। নিজের ঘরে এসে দরজায় খিল দেয়ার পর ক্লান্তি ভর করল পুরোপুরি। দুঃখবোধ বা কষ্ট নয়। মনে হলো বিরাট স্কেলের ম্যারাথন দৌড়ে এসেছি। বাড়তি এক পা চলার শক্তি বাকি নেই এখন। আর তখনই নষ্টালজিয়া হামলে পড়ল আমার উপর।
                       গল্পটি স্পনসর করেছে

ভালোবাসার তিক্ততা - Valobashar Golpo - Bengali Love Story


শুভ্রকে আমি ভালবাসি নিজেকে বুঝতে জানার আগ থেকেই। তখন ও শারিরীক পরিবর্তন কিংবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চাহিদা আর আকর্ষণ বোঝার ক্ষমতা হয়নি আমার। হয়নি চকলেট খাওয়ার চাইতে ভালো কোন কাজ থাকতে পারে তা জানার! তখন থেকেই তাকে আমি ভালবাসি।
ভালবাসি ওর প্রতিটা আচরণ, মুহূর্ত, ওর রাগ, এমনকি ওর বাজে চিন্তাভাবনাগুলোকেও। একটু হয়ত আজব। আমি জানি। খুব দুঃশ্চিন্তায় যখন ওর কপাল কুঁচকে যায়, ও যখন আমার সামনে অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে, ওদের নিয়ে লং ড্রাইভে যায়, কখনও সখনও আমার উপস্থিতিতেই ওদের মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, বিভিন্ন সব আহ্লাদী নামে ডাকে, হাত ধরে হাঁটে এখানে ওখানে- তখন রাগ হয় আমার প্রচন্ড। ইচ্ছে হয় সব ভাঙ্গচুর করি। ভেতরের যন্ত্রণা বেরিয়ে যাক। আর অদ্ভুত ব্যাপার, শুভ্রর জন্য এইসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেও আমার ভাল লাগে। মনে হয় যাই হোক, যেমন হোক কারণটা তো সে! দিনশেষে তার নামটাই তো থাকছে। সামনে আসছে আমার!
আমি জানি সবাই বলবে এটা আমার অবসেশন। আর অবসেশন স্বাস্থ্যকর হতে পারে না। আমি বলব, না। ও আমার। সংজ্ঞা ছাড়াই আমার। কেননা খুব ছোট্ট আপনাকে যখন সারাক্ষণ ছায়ার মত কেউ একজন সঙ্গ দেবে একদম আপনি চারপাশ বুঝতে শেখার পরেও সে চলে যাবে না, প্রতিটা প্রয়োজনে কষ্টে ঘিরে থাকবে, আপনার ভেতরের দানবগুলোকে তাড়িয়ে দেবে, কাঁদতে কাঁদতে চোখ নাকের জল একাকার করা আপনাকে যখন চোখের পলকেই হাসিয়ে ফেলবে- তখন সে মানুষটা আপনার অভ্যেস হয়ে যাবে। মনে হবে আপনার হাত-পা-নাকের মত সেও বুঝি কোন এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আপনার! মনে হবে সে নেই মানে তো সবকিছু অর্থহীন। কোন মানে নেই খুব সুন্দর জীবনেরও। এখন মানুষটা যত বিতিকিচ্ছিরি কাজ করুক না কেন! সাদা শার্টে কালো পকেট লাগাক, রাত তিনটে বাজে আপনার প্রিয় বান্ধবীর নাম্বার চাওয়ার জন্য আপনার সুন্দর স্বপ্নের ঘুমটা ভেঙ্গে দিক, কিংবা আপনাদের একান্ত সময়ে অন্য কাউকে নিয়ে আসুক। আপনার মনে হবে, সে-ই তো। দিনশেষে সে-ই।
তাহলে আজ এই আমার এমন পরিবর্তন কেন?
কারণ একটাই। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি একপেশে ভালবাসা বাসতে বাসতে কখন যে খুব বদলে গেছি নিজেও টের পাইনি। আমি জানি সে টের পেয়েছিলো আমি তাকে ভালবাসি বা বাসতাম। ওর চোখে আমি সেই ভালবাসার লোভ দেখতে পেতাম। দেখতে পেতাম ও সবার কাছ থেকে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ঠিকই আমার কাছে ফিরে আসছে। তারপর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ক্লান্তি কেটে যাওয়ামাত্র আবার আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আটকে দিচ্ছে “বন্ধুত্ব” নামক শিকলে। যে শিকলঘেরা সম্পর্কটা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখে প্রতিবার আরেকটু দূরে নিয়ে আছড়ে ফেলে। সময়ের সাথে বাড়ে সে দূরত্ব। যে দূরত্ব পেরিয়ে ভালবাসি আমি। অত দূর থেকে অনুভূতি ছুঁড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে গেলেও বাসি। অন্তত বাসতাম। অথচ দূরত্ব বেড়ে যেতো প্রতিবার। আরেকটু। আরও একটু। আবার একটু। আর সেটা বাড়তে বাড়তে আজকের এই অবস্থান! যখন তার কোন অনুভূতিই আর ছুঁয়ে দেয় না আমাকে। যখন নিজের চৌহদ্দির অনেক দূর দূরান্তেও দেখা যায় না তাকে। আমি খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। হাত না রেখেও টের পাই বুকের ভেতর খুব গোপনে কোথাও ভাঙ্গচুর চলছে। পাত্তা না দিয়ে ডায়েরীটা টেনে নিই। সবসময়কার মত সম্বোধনে লিখে ফেলি নতুন এক পাতা রোজনামচা।




প্রিয় শুভ্র,
দুঃখিত তোকে তোর আবেগটা একই তীব্রতায় ফিরিয়ে দিতে পারছি না বলে। পারছি না পুরোনো আমিত্বে ফিরে গিয়ে বলতে, “হ্যাঁ রে শুভ্র, আমিও তো তোকে ভালবাসি। যতটা ভালবাসলে এক জনম ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও আবেগ থেকে যায়! যতটা ভালবাসলে লোকে অন্ধ বলে। বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দেয়া যায় কিছু না ভেবেই।” কিন্তু না। হচ্ছে না। তোকে ভালবাসতে বাসতে কখন যে নিজের ভেতরের ভালবাসাটা ফুরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। এখন আমার ভেতর সব তিক্ততা। যে তিক্ততা সময়ের সাথে সাথে শুধু বেড়ে গেছে। বেড়েই গেছে। কখনও প্রিয় বান্ধবীর সাথে তোকে ঘুরতে দেখে। কখনওবা আপন ছোটবোনের মত আদরের কাজিনের হাত ধরে তার চোখে তোর ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকার অভ্যেস তৈরি হতে দেখে। অথবা এর কিছুদিন পর করা তোর সেই কনফেশন,
“আয়্যাম নট এ সেলিবেট এনিমোর, শৈ!”
তারপর সেই কাজিনকেই “হচ্ছে না” বলে সরিয়ে দিতে দেখে। তিক্ততা অনেক তীব্র একটা অনুভূতি, শুভ্র। কখনও সখনও ঘৃণার চাইতে তীব্র।

আজ আবার অনেকদিন পর ‘শৈ’ বলে ডাকলি। হাহ নস্টালজিয়া! আমার সুন্দর ছোট্ট নামটা তোর ডাকে আরও ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাই না? সবাই ডাকে শৈল্পী। তুই ডাকতি শৈ। কেউ কেউ ভাবত তুই বুঝি আমাকে সই ডাকছিস! আমি বুঝি তোর খুব প্রিয়! তখন তোর সে কি ব্যাখ্যা! তুই শুভ্র। সাদা একটা ক্যানভাস। আর আমি শৈল্পী। সেই ক্যানভাসের কারুকাজ। ভিন্ন ভিন্ন রঙের একমাত্র ভান্ডার। একসাথে আমরা শুভ্রশৈল্পী। কিন্তু কখন যে তোকে রাঙাতে রাঙাতে নিজেই রঙহীন হয়ে গেলাম, শুভ্র.. বুঝতে পারিনি! জানিস, শেষ যে ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম সে অনেক নাছোড়বান্দা ছিলো। অনেক অনেক প্রশ্ন তার। আর আমার অনেক অনেক টালবাহানা। ও আঁকড়ে ধরতে চায়। আর আমি আমার ছায়ার সীমানাতেও ওকে ঘেঁষতে দিই না। আমার চারপাশে এখন অনেক দেয়াল। গুটিয়ে যেতে একটুও অসুবিধে নেই আর। সহজ। তবে অবশেষে বাধ্য হয়েছিলাম নিজের রঙহীনতা তাকে ব্যাখ্যা করতে। বলেছিলাম, আমি একটা শূণ্য খোলস। তোমাকে ভালবাসা তো দূরের কথা, তোমার ভালবাসা টেনে নেয়ার ক্ষমতাও নেই। আমার মাঝে আছে অন্ধকার। বিষণ্ণতা। রাতের পর রাত জেগে জমানো নির্ঘুম দুঃস্বপ্ন। আমি ভালবাসতে পারি না এখন আর। নষ্ট হয়ে গেছি। অবশ হয়ে গেছে সব।
শুভ্র, এটাই বোধহয় নিয়তি। আমি বলছি না আমার প্রতি তোর অনুভূতি মিথ্যে। বলছি, তুই দেরী করে ফেলেছিস। আমি ফুরিয়ে গেছি। দূরত্ব এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, মাঝে দেয়াল পড়েছে শত। ওগুলো টপকে শুভ্রশৈল্পী আর হওয়া হবে না কখনও। খুব গভীর করে ছুঁয়ে দেয়া হবে না। এ পৃথিবীতে, এ সময়ে অন্তত নয়। অন্য অচেনা কোথাও। কে জানে প্যারালাল ইউনিভার্সে হয়ত আমাদের ছোট্ট একটা সংসারও আছে! যেখানে তুই আমার কল্পনামতে এক চশমাচোখা। আর আমি খুব এলোমেলো। কিচ্ছু পারি না। আর বোকা বোকা তুই সব পারিস। কিন্তু হয়ত সেখানে দিনশেষে তুই আর আমি। আমরা। শুভ্রশৈল্পী।
ইতি-
শৈল্পী




ডায়েরীটা বন্ধ করে রেখে দিলাম একপাশে। আনমনেই বিড়বিড় করলাম,

“তুমি ছেলেটা আবেগ মাপো,
জ্যোছনা মেখে সবুজে ডোবো।
জল পাহাড়ের ছায়া কোণে,
কাচপুকুরের মায়ার মাঝে,
আমায় কি একটুও ভাবো?
হোক তা খুব সামান্য?
আমি মেয়েটা দূরত্ব গুণি,
হাত বাড়িয়ে গুটিয়ে ফেলি,
বিশাল সব দেয়াল এড়িয়ে,
চোরাচোখে আবার তাকাই,
মনের ভুলে কী যে বলি!
কী যে বলি…”

(সমাপ্ত)

Share This Article