বাংলা সিরিজ গল্প – সিনেমায় যেমন হয় – Bengali Story
শেষ থেকে শুরু
✍️ Ankhi Chatterjee
সকাল আটটায় এলার্ম বেজে ঘুম ভাঙলো দিয়ার। চোখ খুলেই মোবাইল অফ করে দিয়ে,একটা ফোন করল শুভকে। রোজ সকালে ওকে ঘুম থেকে তোলাটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
-গুড মর্নিং।উঠে পড়ো।
-হুম।
-আরে ওঠো ওঠো।অফিসে দেরি হয়ে যাবে নয়তো।
-হুম।উঠছি।
-ওকে বাই। অফিসে পৌঁছে কল করব।
একটা ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠল দিয়া। ছিমছাম ঘর তার, একটা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর একটা স্টাডি টেবিল।ক্লাস নাইন থেকেই এই ঘরটায় রাতে একাই শুয়ে অভ্যস্থ দিয়া।এমনিতে বাড়িতে বাবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। ইউনিভার্সিটি শেষে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে এখন চাকরি করছে দিয়া। ইদানিং নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হয়, নিজের মতো করে চাকরি করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবা-মাও বিশেষ একটা কোন কিছুতে বাধা দেয় না। মাইনের টাকাটা নিজের ইচ্ছামত খরচ করে আর কিছু টাকা ব্যাংক এ সেভিংস করে।বেশ কেটে যাচ্ছে দিন গুলো, কিন্তু দিয়া জানে এরপর এত কিছু সহজ হবে না। সবাই বলে জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়ে যায় বিয়ের পরে। এই নিয়ে বেশ ভয় রয়েছে দিয়ার, সে কথা শুভকে বার কয়েক বলেওছে। কিন্তু শুভ এসব কথা শুনেও শোনেনা। আসলে শুভ চিরকালই স্বল্পভাষী। আবেগ,অভিব্যক্তি, অনুভূতি এইসব ভীষন কম।মাঝেমাঝে দিয়া তাই ভাবে কি করে এই লোককে নিয়ে সারা জীবন চলবে।দিয়ার স্বভাব যে একদম বিপরীত, বড্ড আবেগপ্রবণ দিয়া, কেউ উঁচু গলায় কথা বললেও যে কেঁদে ফেলে।ভীষন সাধারণ মেয়ে দিয়া।দেখতেও অপরূপা নয়, আবার পড়াশোনা তেও তুখোড় নয়।তবুও দিয়া শুভর নজরে অসাধারণ হয়ে উঠতে চায়।
মায়ের ডাকে হুঁশ এল দিয়ার। দেরি হয়ে গেল তো, বাথরুমে ঢুকে প্রাতঃকর্ম সেরে স্নান করে বেরোলো দিয়া।বৃহস্পতি বার, আলমারি থেকে একটা টিয়া সবুজ কুর্তি আর লেগিন্স বার করল। একদিন আলমারিটা গোছাতে হবে, মনে মনে ভাবল দিয়া। বাইরে এসে মাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করলো,বাবা বাজারে গেছে।গরম গরম ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে, লাঞ্চ বক্স ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দিয়া।ওদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড অব্দি গিয়ে ওখান থেকে অটো করে চৌরাস্তা পৌঁছলো। চৌরাস্তা থেকে স্যাটেলে উঠে কানে হেডফোন গুঁজে মিউজিক চালিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিল। হঠাৎ একটা চেনা আওয়াজে চোখ খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৌম।
-কিরে তুই এখানে?
-আমিও তো অবাক হয়ে গেছি তোকে দেখে, বল কি খবর??
-তুই ব্যাঙ্গালোর থেকে চলে এসছিস, কবে এলি? কি করছিস তুই বেহালাতে?
-আরে আমি তো এই দু মাস হল ফিরেছি কলকাতায় চাকরি নিয়ে।এখানে মাসির বাড়িতে রাতে ছিলাম। মাসির শরীরটা খারাপ,তাই মাকে নিয়ে এখানে এসেছি। এখান থেকে আজকে ডিরেক্ট অফিস যাচ্ছি।তোর কি এটাই রুট? যাক ভালোই হল।আমি তো ভাবছিলাম তুই এত দিনে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছিস।
-এই বেশ আছি বাবা।কে যেচে ঝামেলায় জড়াতে চায়?
-ও মাই গড।এই কথা তুই বলছিস,আই কান্ট বিলিভ কি ছিলিস আর কি হয়ে গেছিস এই আট বছরে।
-কেন রে?? আমি খুব বিয়ের জন্য উৎসুক ছিলাম এ কথা তোকে কে বলল।।।
– নানা আই মিন তুই কি রকম ঘরোয়া সংসারী টাইপ এর ছিলিস। যার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বিয়ে করে সুখে সংসার করা কর্পোরেট দুনিয়া থেকে শত হাত দূরে।
কথায় কথায় স্যাটেল ছুটতে লাগলো। দিয়ার স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠলো আট বছর আগের প্রথম সৌমর সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলো…………..
এইচ এস এর একটা নামি কম্পিউটার সেন্টারে এ শর্ট টাইম সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হয়েছিল দিয়া। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় সৌমর সাথে।শোভন, দ্বীপ ছিল সৌমর স্কুলের বন্ধু।ওরা তিনজনে একসাথে ওই কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল।কিন্তু প্রাকটিকাল ক্লাসে একটা কম্পিউটার দুজনে একসাথে প্র্যাকটিস করতে হতো।সেখানেই দিয়ার পার্টনার হয়েছিল সৌম। এই নিয়ে সৌম খুব আওয়াজ খেত সব বন্ধুদের কাছে।শোভন সব সময় ওদের পেছনে লাগত,এত যে মাঝে মাঝে অসহ্য লাগতো দিয়ার। এমনিতে সৌম খুবই ভালো ছিল সব সময় বেশি করে একটু হেল্প করত ওর বাড়িতেও কম্পিউটার ছিল অনেক কিছু এক্সট্রা টেকনিক জানতো সে সব নিয়েই বিস্তর সাহায্য করতে দিয়াকে এবং অন্য বন্ধুদেরকেও।
একটা বর্ষার দিনের কথা মনে পড়ে গেল দিয়ার সেদিন ক্লাস ছিল প্রায় ফাঁকা। দিয়া গিয়ে নিজের কাজ করছিল তবুও বারবার কেন জানি না নজর যাচ্ছিল দরজায়। দিয়া যেন কাউকে মিস করতে শুরু করেছিল।বৃষ্টিতে ভিজে সৌম বেশ কিছুক্ষণ পর হাজির হলো তারপর দুজনে একসাথে প্র্যাকটিস করছিল সেদিন হঠাৎ সৌম্ বলেছিল
“তুই কিছু মনে করিস না আমার বন্ধু গুলো সব সময় ফাজলামো করে। ওদের কত বারণ করি তবু কোনো কথা শোনেনা। আসলে তোকে আমি পছন্দ করি সেটা ওদের বলেই আমি বিপদ ডেকে এনেছি আমি কিন্তু অন্য কোন সেন্সে কথাটা বলিনি তুই এমনিতেই এত ভালো মেয়ে যে তোকে সবার পছন্দ হবে”।
সেদিনই প্রথম একটা ছেলের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠেছিল দিয়া।নিজেকে ভীষন স্পেশাল মনে হয়েছিল তারপর থেকে কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছিল দিয়া।ক্লাসে ঢোকা থেকে বেরোনো পর্যন্ত ইচ্ছা হতো সবসময় সৌমর আশেপাশে থাকার। যেদিন সৌম্ আসতো না, খুব মন খারাপ করত। রোজ নতুন নতুন সালোয়ার পরে নানান রকম ভাবে চুল বেঁধে ক্লাসে আসত। দশ দিনের একদিন হয়তো সৌম বলত ‘বাঃ খুব সুন্দর লাগছে তোকে’ ।ব্যাস সেদিন আর দেখে কে।সেই স্টাইলটা ফলো করে যেত রোজ। তারপর ওর পাঠানো এসএমএস গুলো রোজ ডায়েরি তে লিখে রাখতো। নিজের অজান্তেই কখন যেন ভালোবেসে ফেলেছিল সৌমকে। ক্লাস শেষ হওয়ার কিছু দিন পর সে কথা সাহস করে একবার সৌমকে জানিয়েছিল কিন্তু সৌম মুখের ওপর জানিয়ে দেয় দিয়াকে ও শুধু নিজের বন্ধু ভাবে।দিয়ার মন, অনুভূতি গুলো ভেঙ্গে দিতে সৌমর একটুও বাঁধেনি। বলা বাহুল্য খুব কষ্ট পেয়েছিল দিয়া, তবে ও সেদিন বুঝেছিল দূর থেকে যা চকচক করে তাই সোনা নয়। তারপরে ধীরে ধীরে নিজের কলেজ, নিজের লাইফ এবং নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় তারপর চাকরী।এক বছর আগে বাড়ি থেকে সম্বন্ধ দেখার কথা ওঠে,তখনি শুভর করা প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে দিয়া বাড়িতে জানিয়ে রাখে।
-কিরে তুই তো ভাব সাগরে ডুবে গেলি কি এত ভাবছিস?
-পুরনো কথা।
-সত্যি কি দিন ছিল বল তো।আমারটা এখনো ভেবে হাসি পায়।
-আচ্ছা তোর ওই চ্যাংড়া বন্ধু গুলোর কি খবর রে?
-আছে সব যে যার নিজের নিয়ে ব্যস্ত।বিশেষ কারোর সাথে কন্টাক্ট নেই।আচ্ছা তুই কোন অফিসে আছিস রে?
-আমি ওই একটা নেটওয়ার্কিং সফট্ওয়ারে কাজ করি কলেজ মোড়ের বাঁদিকে আমাদের অফিস।
-ও আচ্ছা আমাকে তো আবার সেই নিউ টাউন ছুটতে হবে।
-আরে বাড়িতে সবাই কেমন আছে?
-ওই আছে মোটামুটি। বয়স হচ্ছে তো বাবা-মায়ের, কিছু না কিছু লেগেই আছে।তার ওপরে আবার আমার বিয়ের জন্য চিন্তা।
-তো এবার বিয়েটা করেই ফেললো দেরি কিসের? পাত্র তো এতদিনে ঠিক করে ফেলেছিস নিশ্চয়ই।
-হ্যাঁ আছে একজন। কিন্তু কি জানিস বিয়ে করবো ভাবলে কি রকম ভয় ভয় করে।সবাই তো আর অনুভূতির মর্যাদা দিতে পারে না।
আরো অনেক রকম কথা বলতে লাগলো দুজনে।
কথায় কথায় ওরা পৌঁছে গেল গন্তব্য স্থানে। যে যার অফিসের দিকে যাওয়ার আগে ফোন নাম্বার এক্সচেঞ্জ করল।
অফিসে ঢোকার সময় অভ্যাসমতো দিয়া ফোন করল শুভকে।
-পৌছে গেছি অফিস। তুমি কোথায়?
-ও আচ্ছা। আমি এইতো বেরোলাম।
-জানো আজ একটা পুরনো বন্ধুর সাথে স্যাটেল হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
– হুমম।তো?
– তো আর কি সারাটা রাস্তা বকবক করতে করতে চলে এলাম।
-আচ্ছা বেশ বেশ।
-তুমি একবারও জানতে চাইলে না ,এ ছেলে না মেয়ে, আমার কলেজের বন্ধু না স্কুলের? সত্যি তুমি না! কি রকম একটা!
-আমি জানি তো, প্রয়োজন হলে তুমি নিজেই বলবে।
-না বলব না,যাও তো। এখন রাখছি।
মুডটাই খারাপ হয়ে গেল দিয়ার। শুভর এই উদাসীন স্বভাবটা দিয়া ঠিক পছন্দ করেনা। দিয়া যে কথা অন্তত উৎসাহ নিয়ে বলতে চায় শুভর প্রতিক্রিয়া সব ভেস্তে দেয়। এই যে পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে তার সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে এসব কথা শুনে কোথায় একটু জেলাস ফিল করবে তা না, কোন পাত্তাই দিলো না।
অফিসে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকে নিজের কিউবিকলে কাজের মধ্যে ঢুকে পড়ল দিয়া। ছোট থেকেই যে কাজ দেওয়া হতো তা মোটামুটি দায়িত্ব নিয়ে করতো দিয়া, তাই পাড়ার কালী পূজার জোগাড় থেকে শুরু করে অফিস পিকনিক অ্যারেঞ্জ করা সবেতেই বেশ অভ্যস্ত দিয়া। দু’বছর হলো চাকরি করছে, এই কোম্পানিতে। দায়িত্বশীল স্বভাবের জন্য বেশ পছন্দ করে সবাই ওকে। দুটো বড় প্রজেক্টের ভার এখন ওর ওপর।অনেক গুলো কাজ পরপর করতে হবে,তার পর একটা মিটিং টিম মেম্বার দের সাথে।
শুভ নিজের অফিসে বসে একটা খবর পড়ছিল ডেক্সটপে, হঠাৎ বিদ্যুত দা ঘরে ঢুকে সামনের চেয়ারে বসে পরলো।
-কিরে কি দেখছিস এতো মন দিয়ে? গার্লফ্রেন্ডের ছবি নাকি? আর কদিন কচি খোকা হয়ে থাকবে চাঁদু?? এবার একটা বিয়ে টিয়ে কর। আমরাও একটু জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করি।
– শালা তোমাদের আমি এমনি খাওয়াই না নাকি যে আমাকে জবাই করে খেতে ইচ্ছা। বলল শুভ।
-ধুর ধুর জবাই কেন রে ?এই তোদের এখনকার ছেলেমেয়েদের সমস্যা। বিয়েটা কে নিয়ে তোদের যে কেন এত ভয়??
কথা ঘোরানোর জন্য বলল ‘আসলে আমি একটা পলিটিকাল আর্টিকেল পড়ছিলাম। বস বাবাজি সাইটে গেছে তাই একটু ফাঁকি আরকি।’
-ও তাই বল। তাই এত হট্টগোল হচ্ছে।
খানিকক্ষণ গেজিয়ে বিদ্যুৎ দা চলে গেল। শুভ একবার ইনবক্সটা চেক করলো। সময় পেয়েছে একটু, ভাবল দিয়াকে একবার ফোন করে নেবে।
এমনিতে সহজ সরল দিয়াকে প্রথম থেকেই বেশ পছন্দ ছিল শুভর। কিন্তু এসব ন্যাকা ন্যাকা প্রেম ভালবাসার শুভর দ্বারা পোষায় না। দিয়াকে শুভ কোন দিন বলেনি যে “আমি তোমাকে ভালোবাসি. বা তোমায় ছাড়া বাঁচবো না।” বরং উল্টো বলেছিল প্রেম তো খালি বইয়ের উপন্যাসে বা সিনেমায় প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে হয় বাস্তবে এসব জিনিস লক্ষ্য করা যায় না। আসলে সত্যি বলতে প্রেম ভালবাসার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধা চলে গেছে সেই মোহর চলে যাবার পর থেকেই। হ্যাঁ শুভর প্রথম প্রেম ছিল মোহর।সেইসময় সারাদিন, সারারাত গল্প করলেও কথা শেষ হতো না। ওকে না দেখলেই যেন মনে হতো দিনটা খারাপ।ওই মুখের হাসির জন্য সব কিছু করতে পারত শুভ।সদ্য এম বি এ পাশ করে ব্যাঙ্গালোরে একটা ছোট চাকরি নিয়ে শুভ মাস তিনেকের জন্য গেছিল। সেখানে থাকার সময় হঠাৎ খবর পায় মোহরের নাকি বিয়ে।। সব কাজ ফেলে, এমনকি চাকরিটাও ছেড়ে বোকার মতো চলে এসেছিল কলকাতায়। কলকাতায় ফিরেই উদভ্রান্তের মত ছুটে গেছিল মোহরের বাড়ি। ভেবেছিল কাকু কাকিমা জোর করেছে বলে হয়তো মোহর রাজী হয়েছে। সেই ভুল ভাঙল যখন নিজের মুখেই মোহর বলল “তোর নিজের কোন ঠিকানা নেই,কোন ভালো চাকরি নেই আমি কি করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াবো বল??” সেদিন এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি শুভ।খালি বুঝে গেছিল সবার আগে সবাই নিজের ভালোটাই বোঝে। তারপর থেকে অন্যদিকে মন না দিয়ে শুভ নিজের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়।
চারটে বছর কেটে গেছে সেই চেষ্টায়, এখন ভালো একটা চাকরি, বাইক, সবই ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়িটাও দোতলা তৈরি করেছে মনের মতো করে, টুকটুক করে একটা দুটো ফার্নিচার কিনে সাজাচ্ছে। এখন বাড়িতেও বিয়ের কথা বলছে সবাই। গতবছর পাড়ার এক দাদার বিয়েতে গিয়ে আলাপ হয় দিয়ার সাথে।দিয়ার বাবা মার সাথেও সেদিনই পরিচয় হয়। বেশ ভালো পরিবার। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সম্পর্কের শুরুর দিকেই দিয়া একদিন বলে ওর জন্য নাকি সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে।।।। তখনই শুভ বলে “সামনে রাজপুত্র থাকতে,আবার তোমার বাবা কোন পাত্র দেখবে শুনি???” দিয়া শুনেই খুব হেসে ওঠে।
কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে শুভ লক্ষ্য করছে দিয়া খুব নির্ভরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে শুভর উপর। শুভ নিজের জীবন নিজের মতো করেই কাটাতে বেশি পছন্দ করে। এমনিতে সারাদিন অফিসের কাজে পরিশ্রান্ত হয়ে যায়, তারপরে ছুটির দিনে বা বাড়ি ফিরে ফোন করতে হবে। দিয়া খুব যত্নশীল ওর প্রতি, হয়তো সেটাই মাঝেমাঝে শুভর কাছে দম বন্ধ লাগে।তবে এখন কখনো কখনো শুভর মনে হয় ভালোবাসা থেকেই তো অধিকার বোধ জন্মায়।দিয়া হয়তো এই অধিকারবোধ থেকেই কিছু প্রত্যাশা করে ফেলে শুভর থেকে। যাই হোক, ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন করল দিয়াকে
-কি মুড অন হলো ম্যাডাম এর??
-হ্যাঁ বল। কি করছো? আমি এই লাঞ্চ করতে বসলাম।
– হুমম।জানি তো দেড়টা বেজে গেছে ।আজ দেখা করবে নাকি??
-বাবা কি ব্যাপার মেঘ না চাইতে জল এমনিতে তো বাবুর সময় হয়না।
-আজ টাইম পেলাম তাই বলছি।
-আচ্ছা কখন বলো?
-তুমি কটায় বেরোতে পারবে?
– ওই ছটা সাড়ে ছটা।
– আচ্ছা তাহলে চলে এসো রাসবিহারী তে। আমি ফোন করে জানিয়ে দেবো কোথায় আছি।
দিয়া ফোন রেখেই দেখল সৌম হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চেয়েছে, কাল কখন স্যাটেল ধরবে।। ও বোধহয় আজও বেহালা ফিরছে। ব্যাপার কি দিয়া ঠিক আন্দাজ করতে পারল না মনে মনে ভাবল একসময়ে যে সম্পর্ক থেকে নিষ্ঠুর ভাবে প্রত্যাক্ষিত হয়েছে সেই অপমান দিয়া কিন্তু চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না কোনোদিন।তবে দিয়ার মনটা আজ খুশি হয়ে গেল এই ভেবে যে আজ হঠাৎ করেই জানো সবাই দিয়ার সান্নিধ্য চাইছে। দিয়ার আবার নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হল।যাই হোক সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে তাই সে দিকে মন দিল। আগে থেকেই বলে দেবে অফিসে,যে ছটার সময় বেরোবে।
শুভ আগেই পৌছে গেছিল দিয়া আসার পর ওরা গোলপার্কের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে আলো আঁধারের মাঝে বসলো। আজ প্রায় তিন সপ্তাহ পরে শুভর সাথে দেখা হল দিয়ার। শুভ মনে মনে ভাবছিল দিয়া কে বেশ দেখাচ্ছে।
-এই রংটা তোমায় বেশ মানিয়েছে। এই রঙের একটা শাড়ি কিনে দেবো তোমায় পুজোয়।
– ধুর। শাড়ি পরি কোথায়??
– এখন না পরো, বিয়ের পরে তো পরবে।
– কার বিয়ে??
– আমাদের বিয়ে অফর্কস।
– আমি কি একবারও বলেছি,যে আমি তোমাকে বিয়ে করব?
– কেন? করবে না বুঝি??
– নাও করতে পারি। আমার হাতে অনেক অপশন আছে, বলে দিয়া ছোট করে চোখ মারল।
– আচ্ছা তাই নাকি? ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে। সকালে যার সাথে দেখা হল সেও কি লাইনে আছে নাকি??
– এবার হেসে ফেলল দিয়া। বললো “জানো সকালে যার সাথে দেখা হল ও আমার পুরনো ক্রাশ। আজকে যখন ও আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সব পুরনো কথা, কিন্তু কি জানো সেই সময়টা আলাদা ছিল তখন আমি ওকে ভীষণ ভাবে চাইতাম মনে প্রাণে। ও নিষ্ঠুরভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল আমার তখন মনে হয়েছিল আমার মতন সাধারন মেয়ের বোধহয় এতটা প্রত্যাশা করা উচিত হয়নি কিন্তু যখন তুমি আমার জীবনে এলে তখন আমার সেই ভুল ভাঙলো আমি আজকে বিশ্বাস করি যে আমিও কারো থেকে কম নয়।তোমার ভালোবাসা আমার পুরনো সেই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে দিয়েছে।”
কথাগুলো শুনে শুভ স্তম্ভিত হয়ে গেল।মনে হল শুভর সামনে যেন আয়না তুলে ধরলো দিয়া। মোহর চলে যাবার পর যে আত্ম-বিশ্বাস শুভর ভেঙে গেছিলো সেই আত্মবিশ্বাস তো দিয়াই ফিরিয়ে এনে দিয়েছে। সত্যিই তো কার দোষের সাজা কাকে দিচ্ছে শুভ??যে মেয়েটা ওকে কোনদিন ভালোবাসিনি তার কথা ভেবে কষ্ট দিচ্ছে এমন একটা মেয়েকে যে তাকে এত ভালবাসে। এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে প্রত্যাখিত হয়ে, দুজনেরই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের সম্পর্ক মিষ্টি মধুর করে তুলবে।
শুভ দিয়ার হাত দেয় জড়িয়ে ধরে বললো “আমাকে একটা কথা দেবে ??”
দিয়া বলল “কি কথা?”
শুভ বলল “আমাকে ছুঁয়ে বল তুমি আমাকে কোনদিন, কোনো পরিস্থিতিতেই একা ফেলে যাবে না ।। হতে পারে আমি অবুঝ,সব কথা সময় মতো বলতে পারি না, নিজের মনের ভাব সব সময় প্রকাশ করতে পারিনা।কিন্তু তুমি আমায় ছেড়ে যেওনা, তুমি চলে গেলে আবার আমি ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারাবো।”
-”ধুর বোকা। হাত ছাড়বো বলে, কি হাত ধরেছি তোমার??” চোখে জল নিয়ে বলল দিয়া।আর যাই হোক এবার সোনা চিনতে ভুল হয়নি দিয়ার।
——-