Bengali Story – বেঁচে থাকার মুখোশ – Bangla Golpo

Bongconnection Original Published
10 Min Read



Bengali Story - বেঁচে থাকার মুখোশ - Bangla Golpo
Loading...

         ফোনটা বেজেই যাচ্ছে । এই নিয়ে পরপর দুবার । সোনালী জানে ফোনটা কার । মুম্বাইয়ের বিখ্যাত প্রোডিউসার অশোক পাটিল । সোনালীর অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাসট্রিতে কাজ করার । সুযোগও এসেছিল । কিন্তু পছন্দসই চরিত্র না পাওয়ায় আর করেনি । আজ হয়ত সেই সুযোগ এসেছে । অথচ একটু আগেই ও চোখের সামনে যা দেখেছে , তাতে এখন ওর কথা বলা তো দূরে থাক , বিছানায় এলিয়ে দেওয়া শরীরটা পর্যন্ত তুলতে ইচ্ছা করছে না ।
   
                      মিস সোনালী চ্যাটার্জী…..টলিউডের টপ নায়িকা । চোখ ধাঁধানো রূপ আর অসামান্য অভিনয় – এই দুইয়ের গুণে খুব কম সময়তেই সে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে । বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি , বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় এখন সে অভ্যস্ত । ফেসবুক – টুইটারে ফলোয়ারের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে । সাফল্য আজ তার পায়ের তলায় । এহেন সোনালীর আজ নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে !
   
                    ধীর পায়ে সে উঠে হাঁটতে শুরু করল বাথরুমের দিকে । বাথরুমের দেয়ালজোড়া আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে । না…..রূপে তো সে কোনোদিক দিয়ে কম নয় । তবু কিসের টানে সুদীপ্ত ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে পড়ল ? অথচ প্রথম দিকে এই সুদীপ্তই সিনেমায় তেমন কোনো ভালো সুযোগ পাচ্ছিল না । তখন এই সোনালীর জন্যই সে প্রথম সারা জাগানো এক চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেল । তাও প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেল । সেই শুরু , আজ সুদীপ্তও যথেষ্ট নাম করে গেছে অভিনয় জগতে । সেই দিনের পর থেকে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে । শেষে দুজনেই স্থির করে – আর নয় , এবার একসাথে থাকতেই হচ্ছে।সেই থেকে ওরা দুজন লিভ ইন সম্পর্কে আছে । আজ ওর কোনো এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে যাওয়ার কথা , অথচ একটু আগেই সোনালীর কালো কাঁচে ঢাকা মার্সিডিসটার ঠিক পাশে এসে দাঁড়াল একটা সাদা রঙের স্করপিও গাড়ি । আর তখনই সোনালীর চোখে পড়ল তনুশ্রীর পাশে বসে থাকা সুদীপ্তর দিকে । তনুশ্রী হাসতে হাসতে বার বার সুদীপ্তর গায়ে ঢলে পড়ছিল । আর ওর গালে – গায়ে অকারনেই ছুঁয়ে দিচ্ছিল নিজের হাত । শেষে সুদীপ্তও একেবারে জরিয়ে ধরল ওকে ! নাঃ , আর দেখতে পারেনি সোনালী , লজ্জায় ঘেন্নায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল ।অনেক আগেই এরকম কানাঘুষো শোনা গেছিল ঠিকই । তবে সুদীপ্ত কোনোওদিন স্বীকার করেনি এই সম্পর্কের কথা । যে সুদীপ্তর জন্য ও এত কিছু করেছে , বলতে গেলে একরকম কেরিয়ার গড়ে দিয়েছে , কত সোর্স খাটিয়েছে , কত টাকা খরচ করেছে – সেই সুদীপ্তই কিনা শেষে…..ছিঃ । আজ যদি সুদীপ্ত ওর মুখোমুখি হত তাহলে কী বলত ? বলত কি , “আজ তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে ” ? কি অপমান , কি লজ্জা ওর নারী জীবনের ! ধিক্কার এমন জীবনকে !
   
                 একটা ব্লেড……..হাতে নিয়ে আয়নার দিকে চেয়ে দেখল । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে কিছুক্ষণ স্থির অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল । তারপর ওর চোখ ওই প্রতিবিম্বকে পেরিয়ে অনেক , অনেক দূরে চলে গেল । খুব ছোটবেলায় সে মাকে তারপরে বাবাকে হারিয়েছে । মার কথা তো ওর মনেই পড়ে না । তারপর মামারবাড়িতে অনাদরে মানুষ । অনেক কষ্ট করে , দিনরাত এক করে কাজ করে আজ ও এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে । যে ভালোবাসা খুঁজে বেরিয়েছে চিরটা কাল , সেই ভালোবাসার খানিকটা খুঁজে পেয়েছিল সুদীপ্তর ভিতর । কোনো পুরুষকে কোনোদিন এত কাছে দেয়নি , যতটা ও সুদীপ্তকে আসতে দিয়েছে । সুদীপ্ত ছাড়া আজ ওর আপন বলতে কেউ নেই । সোনালী জানে ও আজ সিনেমার জগতের অনেকেরই ঈর্ষার পাত্রী । কিছুরই অভাব নেই ; তবু কিসের যেন একটা অভাব ওর গোটা জীবনটা জুড়ে আছে । আজ আত্মহত্যা করার মুহূর্তে এই কথা ভাবতেও ওর অবাক লাগে , ও নাকি এমন এক এন-জি-ও সংস্থার সঙ্গে জড়িত যারা কিনা নির্যাতিত , অবসাদগ্রস্ত মেয়েদের নতুন করে বাঁচার পথ দেখায় ! সোনালীর সবসময় এত হাসিখুশী থাকার রহস্যটা কি – অনেক ইন্টারভিউতেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন ওকে হতে হয়েছে । আসলে মানুষ ওর বাইরের এই হাসিমুখের মুখোশটা দেখেই অভ্যস্ত , ওটাকেই সবাই সত্যি বলে মনে করে ! অথচ ভিতরের আসল মানুষটা তো ক্ষত-বিক্ষত , রক্তাক্ত । এরকম একটা ইমেজধারী মানুষের আত্মহত্যার খবর যখন কাল টিভিতে দেখাবে তখন সবাই কি ভাববে ভেবে ওর হাসি পেল । ব্লেডের কাগজটা এবার খুলে ফেলল । ভালো ভাবে নিজের বাঁ হাতের কবজিটার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল , ঠিক কোন জায়গা দিয়ে কাটলে প্রচুর রক্তপাত এবং নিশ্চিত মৃত্যু হবে ! এমন সময় আবার ফোন । হাতটা একটু কেঁপে উঠল । উফ্ আবার অশোক পাটিল…..নাঃ , এইবারে সোজাসুজি রীতিমত অপমান করে দেবে লোকটাকে । একি , রীতা দি । এখন !

– হ্যালো ।

-হ্যালো , কি রে গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন তোর ? খবরটা পেয়েছিস ?

– কোন খবর ?

– ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড এর খবরটা ।

– ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ?




– তার মানে পাসনি । ওরে , তোর লাস্ট রিলিজ করা ছবিটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে । আর তুই হলি সেরা অভিনেত্রী , বুঝলি ? তুই সেরা অভিনেত্রী হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছিস । পার্টি চাই কিন্তু , দারুন একটা পার্টি চাই ।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল রীতা মজুমদার । ইন্ডাস্ট্রির অনেক পুরোনো আর সোনালীর খুব আপন মানুষ এই রীতা দি ।
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সোনালি । তারপর বলল ,
– তুমি সত্যি বলছ ?

– আরে হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ । আমি তোকে এই নিয়ে মিথ্যে বলব ?

– আচ্ছা , থ্যাঙ্ক ইউ । আমি তোমাকে একটু পরে ফোন করছি ।

– হ্যাঁ বুঝেছি , যা যা আগে সুদীপ্তকে জানা ।
ফোনটা কেটে গেল ।

                সুদীপ্ত ! সত্যি সব খবরই তো ও সবার আগে সুদীপ্তকেই জানাতো । এত ভালোবাসতো , তবু কয়েকবার রাগের মাথায় সোনালীর গায়ে হাত তুলতেও ছাড়েনি । সোনালীর জীবনে আজ খুব খুশীর এক মুহূর্ত । যে কোনো অভিনেত্রীই এই খবরে খুশি না হয়ে পারে না । কিন্তু কি করবে ও ? আরো…..আরো উপরে উঠবে ? নাকি সব কিছু আজ এখানেই শেষ করে দেবে ? কোনটায়  লাভ ? আপন বলতে তো ওর আজ কেউ নেই । শুধু বিশাল সংখ্যক অনুরাগী ছাড়া । যারা ওর এই মুখোশের রূপটা দেখেই কী ভীষন ভালোবাসে ওকে । সবাই জানে সোনালী কখনো হারতে শেখেনি , কখনো কাঁদতে শেখেনি । অনেকে উঠতি তারকারই নাকি ও এইজন্য রোল মডেল । তবে কি লাভ সবকিছু শেষ করে দিয়ে ? এই মুখোশটাই অক্ষত থাক । ভিতরের মানুষটার যতই রক্তক্ষরণ হোক না কেন , তার বহিঃপ্রকাশ কোনোভাবেই করা যাবে না । এই খ্যাতির মোহভরা আলোকিত দুনিয়ায় না হয় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই……এই মুখোশটা অক্ষত থাক । রীতা দির ফোনটা এসে ভালোই হয়েছে । একটা খড়কুটোকে আশ্রয় করে সোনালী বেঁচে থাকার বাহানা খুঁজে পেল । এই দীর্ঘ পথ সুদীপ্তকে ছাড়া একা একাই পাড়ি দেবে বলে মনস্থির করল ।
     
           ব্লেডটা সোনালী ডাস্টবিনে ফেলে দিল । খুব ভালো ভাবে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিল । এবার ওয়ারড্রব ঘেঁটে একটা অফ শোলডার গাউন পড়ল  আর সেই মত মানানসই মেকআপ করল । অনেকক্ষণ ধরে , যত্ন করে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তুলল । এবার ফটো তোলার পালা । পরপর কয়েকটা সেলফি তুলে সেগুলো পোস্ট করে দিল স্যোশাল মিডিয়ায় । ব্যাস , নিমেষের মধ্যে লাইক আসতে শুরু করল । আয়েশ করে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে হাতে তুলে নিল স্কচের গ্লাস ।কাল সুদীপ্তর সঙ্গে ব্রেক আপটা করতেই হবে , আর নয় । আত্মসম্মানের প্রশ্ন , আত্মগ্লানি থেকে বাঁচার প্রশ্ন ।
       
                  ব্যক্তিগত জীবন যেমনই হোক না কেন , মুখোশের আড়ালে চোখের জল , রাত জাগা , ক্লান্তির কালো ছোপ তো ঢাকতেই হবে । আর তাই জন্যই মুখোশটাকে যত্ন করতে হবে…..এইই তো জীবন…..আর কি চাই ???…….. সোনালী নিজেকে বোঝাতে শুরু করল । তবু ওই কাজলটানা হরিণীর মত দু’চোখের কোণ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল । যত্ন করে আঁকা লাল লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট দুটোও যেন একটু কেঁপে উঠল ।

Share This Article