গল্পের নাম দেখেই পাঠকমহলের বহুলচর্চিত বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু – এ আবার কি উদ্ভট গল্পের নাম? ডাক্তারি নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন কিংবা করছেন তারা ভাবছেন তো ডাক্তারি পরিভাষাতে এমন কোনও উপসর্গের কথা শোনেননি? তাহলে আর ভনিতা না করে চলে আসা যাক গল্পের প্লটে |
গল্পের শুরুতে একটা বিষয় বলে রাখি এই উপসর্গ চেনার জন্যে আপনার ডাক্তারি জ্ঞান না থাকলেও চলবে,শুধু চোখ কান খোলা রাখলেই এই উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় | আমাদের এক বন্ধু ছিল প্রবাল | সকলের সাথে মিষ্টি ব্যবহারের জন্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল স্কুলে | খেলার মাঠ থেকে প্যান্ডেল হপিং – প্রবালকে ছাড়া ভাবাই যেত না | একবার ক্লাস এইটে টপ করলো প্রবাল | সবাই মিলে ধরলাম ওকে ‘ভাই,ট্রিট চাই এবার কিন্তু’ | প্রবাল রাজি হয়ে গেল | হোটেলে গিয়ে সবার জন্যে আমিষ খাবার অর্ডার দিয়ে নিজে দেখি সব্জি ভাত নিয়েছে | সবাই চেপে ধরতে অকপট স্বীকার করলো – ‘আমিষ নৈব নৈব চ ভাই | আমি পিওর ভেজিটেরিয়ান | তোরা খা’ | বেশ অবাক হয়েছিলাম সকলে | একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে চেয়েছিলাম | এত কম বয়সে আমিষ নিরামিষ মানে দেখে খুব ভালো লাগলো সবার | আসলে ঘরে নিরামিষ খেলেও অনেকে বন্ধুদের সাথে বাইরে এলে মাছ মাংস খায় | অন্তত খাদ্যরসিকদের কাছে প্রবাল বেশ শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলো | আমি হলে নিশ্চিত মাংস খেয়ে নিতাম | অভিভাবকদের কড়া শাসনের মাঝে এইটুকুই তো সময় একটু নিজের মত করে বাঁচার | পড়াশোনার চাপে প্রবালের ব্যাপারটা সবাই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম | ক্লাস নাইনে কিংবা টেনে সেরকম কেউ আর ট্রিট দেয়নি | আসলে সবাই ঠিক করেছিলো মাধ্যমিকের রেজাল্টের পরে না হয় আবার একদিন একসাথে খাওয়া যাবে | তো এবার দেবাশিস ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেছে বলে ঠিক হল ওই ট্রিট দেবে | যথারীতি বাকিদের জন্যে মাটন বিরিয়ানি,চিকেন চাপ,এগ কারি আর প্রবালের জন্যে পোলাও আর পনির পাসিন্দা অর্ডার করা হলো | খাবার অর্ডার দিয়ে খাবার টেবিলে সার্ভ হওয়ার এই বিরতিটা দীর্ঘতম বিরতি আমাদের মত খাদ্যরসিকদের কাছে | ২৫ মিনিট পর ওয়েটার যখন খাবার সার্ভ করে গেল একটা ব্যাপার দেখে আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম | প্রবাল এগ কারি নিচ্ছে পোলাও এর সাথে | যখন বুঝতে পারলো ছয় জোড়া চোখ ওকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে তখন আমতা আমতা করে বললো ‘আসলে তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি আমি কিছুদিন হলো ডিম খাচ্ছি,তবে চিকেন নৈব নৈব চ’ | যাক সে যাত্রা আমরা প্রবালকে উৎসাহ দিলাম আমাদের নন ভেজদের মাঝে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে | প্রবাল লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ডিম আর ধোঁয়া ওঠা পোলাও এ মনোসংযোগ করলো |
আবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম | ক্লাস টুয়েলভের পর আর্য ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেছে | ওর ইচ্ছে এবার ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করবে | ও সবাইকে ট্রিট দিতে নিয়ে গেল এবার | আমাদের জন্যে বাটার নান,চিলি চিকেন আর প্রবালের জন্যে প্লেইন নান আর ডিম অর্ডার করা হল | আগেরবারের মত আমাদের চমকে দিয়ে ব্যাটা প্রবাল চিলি চিকেন নিয়ে নিজেই আত্মপক্ষসমর্থনে বললো ‘আসলে চিকেনটা এখন খাওয়া শুরু করেছি ডাক্তারের পরামর্শে,তবে মাটন নৈব নৈব চ’ | আমাদের ভালো লাগলো আমাদের বন্ধু এতদিনে আমিষ খেতে পছন্দ করছে |
প্রবালকে আমরা কতবার বলেছি সবাই ‘ভাই,কলেজে উঠে গেলি,এবার তো একটু প্রেম ট্রেম কর’ | লজ্জায় মাথা নামিয়ে বলেছে ‘বন্ধুত্ব ঠিক আছে ভাই,প্রেম আমার দ্বারা নৈব নৈব চ’ | সবাই মিলে একদিন ঠিক করলাম প্রবালের জন্মদিনে ওকে না জানিয়ে ওর বাড়ি গিয়ে হাজির হয়ে সারপ্রাইজ দেবো | যেমন ভাবা তেমন কাজ | আমি,আর্য,দেবাশিস,ঋতম,শুভেন্দু মিলে গেলাম প্রবালের বাড়ি | প্রবালের মা মানে কাকিমা যখন দরজা খুলে দিলেন,আমরা সকলে প্রবালের কাছে গেলাম | গিয়ে আমরা সকলে অবাক | ব্যাটা খাসির মাংস,চিকেন বিরিয়ানি,চিংড়ি মালাইকারি,কাতলা কালিয়া নিয়ে বসেছে | আবার পাশে বসে ঋতুপর্ণা বারবার বলছে ‘বাবু,মাটন আর একটু দেবো? তুমি তো খুব পছন্দ করো’ | প্রবাল আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল |
মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে দেবাশিস বললো ‘তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি রে,মাটন আর চিংড়ি খাওয়া রিসেন্টলি শুরু করেছি,তবে বিফ নৈব নৈব চ’ | আবার ঋতম সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো ‘জানিস এই কিছুদিন হল প্রেম করা শুরু করেছি,তবে বিয়ে নৈব নৈব চ’ | প্রবাল বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে বুঝতে পেরে আর্য একদম গম্ভীর হয়ে ডাক্তারের মত বললো ‘বন্ধুগন,এটা নিয়ে হাসাহাসি করার কিছু নেই | এটাকে বলা হয় নৈব নৈব চ সিন্ড্রোম | তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি বায়োলজি ল্যাবে আরশোলার ডাইসেকশন করেছি আমি,কিন্তু ব্যাঙের ডাইসেকশন নৈব নৈব চ’ | সবাই ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে হো হো করে হাসতে লাগলাম |