Bangla Golpo – ডোমের মা – Bengali Story

Bongconnection Original Published
25 Min Read
Bangla Golpo – ডোমের মা
Bangla Golpo - ডোমের মা - Bengali Story
Loading...




     
   কালবৈশাখীর দাপট আজকে যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে।ঝড়টা যদিবা থেমেছে, বৃষ্টির তোড় এখনও প্রবল।তার সঙ্গে রয়েছে ঘনঘন বিদ‍্যুতের চমকানি।এই দুর্যোগের মধ্যে গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে বিজু ডোম।একমাথা ঝাঁকড়া চুলের ওপর গামছার ফেটি বেঁধে আর হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে রাতবিরেতেও ঘুরে বেড়ায় বিজু।সাপ-খোপ,  ভুত-প্রেত,চোর-ডাকাত–কেউই সাহস করেনা বিজুর ত্রিসীমানায় আসতে।পরনের খাটো ধুতি ও কাঁধকাটা ফতুয়ার ভেতর থেকে যখন উঁকি দেয় বলিষ্ঠ বিজুর দেহসৌষ্ঠব,তখন সেদিকে তাকিয়ে কহাত দূর দিয়ে হাঁটে গুন্ডা মাস্তানরাও।তবে চব্বিশ বছরের যুবা বিজুর সেই রূপ দেখলে, অনায়াসে কুপোকাৎ হয় ডোমপাড়ার যুবতীরা।তারা কিন্তু বিজুকে মোটেই ভয় পায়না।বরং বিজুই ভয় পায় তাদের।তাই এড়িয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
      অন‍্য সবাইকে এড়াতে পারলেও,মনের মধ্যে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে বাদল ডোমের মেয়ে–পরী।তাড়ালেও কিছুতেই সামনে থেকে যেতে চায়না ফিচেল মেয়েটা।কিন্তু না,মনকে কোনভাবেই দূর্বল করবে না বিজু।মেয়েছেলে জাতটাকে ও মোটেই বিশ্বাস করে না।একটু বড় হয়ে যখন পাড়ার লোকের কাছে নিজের মায়ের কথা শুনেছিল,তখন থেকেই নারীজাতির ওপর চরম বিদ্বেষ জেগেছে বিজুর মনে।পাঁচ মাসের সন্তানকে ফাঁকা বাড়িতে একা ফেলে রেখে যে মা পরপুরুষের সঙ্গে সংসার ছাড়তে পারে,সে মা নামের কলঙ্ক।এর পর আর কোন মেয়েকেই বিশ্বাস করে না বিজু। যে পরী আজ  সবসময় দরদ দেখাতে আসছে, সেই যে এমন কিছু করবে না,তার কি ভরসা আছে?নেই।আর নেই বলেই, নিজের মনটাকে কোন সময় দূর্বল হতে দেয়না বিজু। 
      জীবনে শুধু একটা মানুষেরই ভালবাসা পেয়েছিল বিজু।সে আর কেউ নয়, বিজুর বাপ হরিপদ ডোম।ডোমপাড়ার সকলের যে একটা পদবী আছে,সেকথা মনে রাখেনা কেউ।ছোট্ট এরিয়াটাকে বহুবছর ধরে ডোমপাড়াই বলে গ্ৰামের মানুষ।ভালো মানুষ হিসেবে পাড়ায় সুখ‍্যাতি ছিল হরিপদ ডোমের।তবে সাহসীও ছিল খুব।বউ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর,সেই মানুষই অসহায় হয়ে পড়েছিল।পাঁচ মাসের ছেলেকে নিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।তবু হাল ছাড়েনি মানুষটা।ছেলের জন‍্য কাজকর্ম ছাড়া সম্ভব ছিল না।তাই মাসখানেক বাড়িতে থেকে, ছমাসের ছেলেকে পরীর ঠাকুমার জিম্মায় রেখে কাজে যেতো।এর জন‍্যে নিজের উপার্জনের অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতো তাকে।ছেলে দুবছরের হতেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতো হরি।ওকে গাছতলায় চট পেতে বসিয়ে রেখে, শশ্মানের কাজ করতো।এইভাবেই বড় হয়ে উঠেছে বিজু।
    *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
     বাবার কথা ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছিল বিজু।হঠাৎ খুব কাছাকাছি প্রচন্ড জোরে একটা বাজ পড়ল।সেই বিকট শব্দে ভয় পেল বিজুর মতো সাহসী ছেলেও।ওর চলার গতি মন্থর হল।কোথাও একটু দাঁড়ানো দরকার।কিন্তু আশ্রয় নেবে কোথায়, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছেনা।কোথাও বাড়ি ঘরের চিহ্ন নেই।চারদিকে শুধু ধু-ধু মাঠ।চেনা জায়গা।ডানদিকে তাকাতেই চোখ গেল গঙ্গার ধার ঘেঁষে মোটা গুঁড়ির অশ্বত্থ গাছটার দিকে।ওই গাছের ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিতো ছোটবেলায়।ওরই তলায় কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নেবে বলে,দ্রুত পা চালালো বিজু।
      বিজুদের গ্ৰামের ভেতর দিয়ে মোড়ামের রাস্তা একটা চলে গেছে শহর পর্যন্ত।কিছুদিন আগেও গ্ৰামের সবাই তিন কিলোমিটার দূরত্বের এই রাস্তাটা মোটরবাইক, বাইসাইকেল, ভ‍্যান-রিক্সা বা মোটরভ‍্যানে যেতো।টোটোর প্রচলন হওয়ায়,এখন তাতেই যাতায়াত করে অনেক মানুষ।তবে বিজু ওসবের ধার ধারেনা।কেউ সাইকেল কেনার কথা বললে, বলে―আমার সাইকেলে কাজ লাই।অত আয়াস করলে গতরে ঘুন ধরবে।
সেই আশঙ্কার থেকেই হয়তো গঙ্গার ধার বরাবর সটকার্টের রাস্তাটা দিয়ে ও পদব্রজেই যাতায়াত করে প্রতিদিন।
     বাবা মারা যাওয়ার পর শহরের শশ্মান ঘাটে দাহ করার কাজটা পেয়েছে বিজু।ইলেকট্রিক চুল্লির পাশাপাশি প্রতিদিন চিতার আগুনে দাহকার্য হয় যথেষ্ট সংখ্যক মৃতদেহের।কোনদিন রাতে, কোনদিন দিনের বেলায় ডিউটি থাকে বিজুর।কাল সন্ধ‍্যের থেকে আজ সন্ধ‍্যে পর্যন্ত ডিউটি করে ফিরছে বিজু।বাঁহাতে লাঠি ও ডানহাতে টর্চ নিয়ে বের হয়েছে। ঠিক ছটার সময় বেরিয়েছে।লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে তিন কিলোমিটার রাস্তার প্রায় আড়াই কিলোমিটার এসেও গেছে।আর একটু সময় পেলে, বৃষ্টির আগেই ঘরে ঢুকে পড়তো।কিন্তু সেটা হলনা কালবৈশাখীর দাপটে।মনে মনে গজগজ করলো বিজু মা শশ্মান-কালীকে উদ্দেশ্য করে―এর লেগেই রাগটো হয় তুমার উবরি মাগো।আর খানিক বাদে ঝড়জলটা দিতে পারলেক লাই?কি ক্ষেতিটা হতো তালে?
      গাছের তলায় এসেই চমকে উঠলো বিজু।দুপুরের দিকে গঙ্গায় জোয়ার এসেছিল।তখনই হয়তো এমন কান্ডটা ঘটেছে।জলের ওপর নেমে আসা দুতিনটে মোটা অশ্বত্থের ডালের মধ্যে আটকে আছে দেহটা।ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানির মধ্যে দেহটা নজরে পড়তেই, টর্চ জ্বালিয়ে ভালো করে দেখলো বিজু।দেহটা একজন মধ‍্যবয়স্কা মহিলার।বয়স সম্বন্ধে সঠিক কোন ধারণা না থাকলেও,বিজুর মনে হল–এর বয়স পরীর ঠাকুমার মতোই হবে।বিজু জলের দিকে নেমে গেল।কাছাকাছি যেতেই মনে হল মহিলার ঠোঁটটা নড়ছে।ভাল করে পরীক্ষা করার জন‍্যে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল বিজু।একটা মৃদু গোঁগানি কানে এল।
      কিছুক্ষণ ভাবার পরই বিজু বুঝতে পারল,এই দেহ জলে ভেসে আসেনি।যেভাবে গাছের ডালের উল্টো দিকে আটকানো রয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে ওপর থেকে গড়িয়ে এসে পড়েছে দেহটা।এই মানুষটাকে নিশ্চয় কেউ মেরে ফেলতে চেয়েছিল।হয়তো খানিক আগেই একে নৌকা করে এনে, জলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু গঙ্গায় সারাক্ষণ লঞ্চ, নৌকা,ভটভটি–এসব যাতায়াত করায়,ফেলার সুযোগ পায়নি।তাই এই আঘাটায় ফেলে দিয়ে গেছে।হয়তো ভেবেছিল কুকুর আর শকুনে ছিঁড়ে খাবে।কিন্তু এই দূর্যোগে না আছে কুকুর, না আছে শকুন।তাছাড়া মানুষটা যে বেঁচে আছে, সেটাও জানতো না।
     অগ্ৰপশ্চাৎ না ভেবে, পাঁজাকোলা করে ডাঙ্গায় তুলে নিয়ে এল বিজু দেহটা।এতক্ষণ পর বৃষ্টিটাও থেমেছে।জলের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকার জন্য জল হয়তো তেমন পেটে যেতে পারেনি।দুহাত দিয়ে মুখটা হাঁ করানোর চেষ্টা করলো বিজু।ততক্ষনাৎ নাকে এল একটা কটূ গন্ধ।গন্ধটা কিটনাশক বিষের।আর দেরি না করে,কাঁধের মধ্যে দেহটাকে তুলে নিলো বিজু। আধ কিলোমিটার হেঁটে দীনেশ ডাক্তারের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে লাগল ঘন ঘন।
      *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      দরজা খুলল দীনেশ ডাক্তারের ছেলে।দরজার গোঁড়ায় শোয়ানো অচৈতন্য মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল― কি ব‍্যাপার বিজু? তুই এত জোরে জোরে বারবার কড়া নাড়ছিলি কেন?আর এই মহিলাই বা কে?তুই এনাকে পেলি কোথায়?
বিজু বলল― সব বলবো গো দাদাবাবু।আগে ডাক্তরবাবুকে একটু ডাকো।
      এরপরই বাঁধলো গন্ডগোল।দীনেশ ডাক্তারের ছেলে কোনভাবেই রাজি নয় বাবাকে ডাকতে।অপরিচিত ও অচৈতন্য একজন মহিলার চিকিৎসা বাবাকে দিয়ে করাতে দেবে না সে পুলিশকেস হওয়ার ভয়ে।এদিকে বিজুও ছাড়বেনা।দরজা আগলে দাঁড়িয়ে সেও ক্রমাগত কাকুতি মিনতি করছে।ওদের কথা কাটাকাটি কানে যেতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দীনেশ ডাক্তার।এইটার জন‍্যেই চ‍্যাঁচামেচি করছিল বিজু।ও জানতো দীনেশ ডাক্তার বেরিয়ে আসলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।চেষ্টা না করে,দরজা থেকে ফিরিয়ে দেন না তিনি কোন রোগীকেই।
      বাড়ির সংলগ্ন চেম্বারে মহিলাকে নিয়ে যেতে বললেন ডাক্তার দীনেশ মুখার্জী।সেখানেই শুরু করলেন চিকিৎসা।খবরটা চাউড় হওয়ার ভয়ে  অ্যাসিস্ট‍্যান্টকে ডাকলেন না ডাক্তার মুখার্জী।ওনার স্টোমাক-ওয়াশ করানোর ব‍্যাপারে ডাক্তারকে সাহায্য করল বিজু নিজেই।ঘন্টাখানেক পর চোখ মেলে তাকালেন মহিলা।বিজু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আরো ঘন্টাদেড়েক চেম্বারের বেডে শুইয়ে রেখে, মহিলাকে উঠে বসতে বললেন  ডাঃ দীনেশ মুখার্জী।
     ভদ্রমহিলা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।ডাঃ দীনেশ মুখার্জী ভদ্রমহিলাকে যা যা প্রশ্ন করলেন,তার সবকিছুরই উত্তর দিলেন উনি।শুধু নিজের নাম ঠিকানা বলতে রাজি হলেননা।ভদ্রমহিলা যা বললেন,তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডাঃ দিনেশ মুখার্জী।
― আমার স্বামী তাঁর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর, একবছরের শিশুপুত্রকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে বিয়ে করেছিলেন।আমি কথা দিয়েছিলাম, আমার দ্বারা তাঁর সন্তানের কোন ক্ষতি কখনো হবেনা।আজ যদি আমার নাম,ঠিকানা জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে কিছু প্রশ্ন উঠে আসবে।আর তার থেকেই সকলে জেনে যাবে আমার সৎ ছেলে ও বৌমার সমস্ত কীর্তি।
―আপনি কলকাতা থেকে এখানে এলেন কি করে,সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলা বললেন


―সেটা আমিও জানিনা।তবে অনুমান করতে পারছি।আমি লুকিয়ে একটা অরফানেজে টাকা দিতাম।সেটা জানতে পেরে হিংস্র হয়ে যায় ওরা।নতুন করে উইল তৈরী করে আমাকে দিয়ে জোর করে সই করিয়ে নেয়।জোর করে আমার আলমারিগুলোর চাবি নিয়ে নেয়।সেইদিন রাত্রেই আমাকে জোর করে বিষ খাইয়ে এখানে ফেলে রেখে যায়।হয়তো প্রথমে গাড়িতে গঙ্গার ধার পর্যন্ত এনে,কোন মোটরবোটে করে এপারে এনেছে।নিশ্চয় সবই পূর্বপরিকল্পিত। আর এর পরের ঘটনা আমার থেকে আপনারা বেশি ভালো জানেন।এইসব প্রকাশ হলে তাদের কি শাস্তি হবে, সেটা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়?সেটা যদি হয়,তাহলে তাদের কষ্টের কারণ হবো আমি।যা করলে আমার সত‍্যভঙ্গ করা হয়,তেমন কাজ আমি জীবন থাকতে করতে পারবো না ডাক্তারবাবু।
ডাঃ মুখার্জী বললেন―তাহলে আপনি এখন কি করতে চান?
ভদ্রমহিলা দৃঢ়স্বরে বললেন― বেঁচে যখন গেলাম, তখন কাল সকালে উঠে নাহয় আগামী দিনের কথা ভাববো। আজ রাতটুকুর জন্য বরং তার সঙ্গেই যাই,যে আমায় নতুন প্রাণ দিল।
বিজু বলল―ডাক্তারবাবু,আমি এবার উনাকে লিয়ে বাড়ি পানে যাই?
বিজুর দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন ―এবার এনাকে নিয়ে তুই কি করবি,ভেবেছিস বিজু?
বিজু কোন দ্বিধা না করে সোজাসাপটা উত্তর দিল ― আমি এই মাকে লিজের ঘরে লিয়ে যাব এখনি।যত দিন বাঁচবো, লিজের ভাতটো ভাগ করে খাবো দুজনে।
ডাক্তার মুখার্জী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন হরিপদ ডোমের নিরক্ষর ছেলেটার দিকে।
     বিজু আবার ভদ্রমহিলাকে কাঁধে তুলতে যাচ্ছিল। দীনেশ ডাক্তার হেসে বললেন―আর ওনাকে কাঁধে তুলতে হবে না।উনি মোটামুটি সুস্থ।তুই তোর মাকে হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যা।তবে একটা কথা মনে রাখবি।তুই কিভাবে ওনাকে উদ্ধার করেছিস,বা আমার কাছে নিয়ে এসে যে সুস্থ করেছিস–এইসব গল্প কারো কাছে করবিনা।নিজের আত্মীয় হিসেবে ওনার পরিচয় দিবি।নাহলে তোর বাড়িতে পুলিশের ঝামেলা হবে।মনে থাকবে তো কথাটা?
বিজু ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানিয়ে ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল দীনেশ ডাক্তারের বাড়ি থেকে।
    *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      রাত্রিতে বিজুর বাড়িতে কেউ খোঁজ নিতে না এলেও সকাল হতেই একে একে অনেকে এল।সবার আগে হাজির হলো পরী।কাল রাতে বিজু নিজের ধুতি গামছা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল,সেগুলো পরে ভিজে কাপড়-জামা ছেড়ে দিতে।তাই করেছিলেন বিজুর নতুন মা।বিজু রাতেই সেগুলো কেচে বারান্দায় শুকোতে  দিয়েছিল।সেই কাপড় দেখতে পেয়েই কৌতূহল বেড়েছে পাড়ার কিছু মানুষের।
পরী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো উঠোনে
― মেয়েমানুষ দেখলে যে নাক সিঁটকোয়,তার বাড়িতে মেয়েমানুষের কাপড় ক‍্যানে? কে এয়েচে তুমার বাড়ি?
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গর্জে উঠলো বিজু―মুখ সামলে কথা কইবি পরী।যে এয়েছে,সে তোদের মতো কোন পাজি মেয়েমানুষ লয়।সে আমার মা।
খিলখিল করে হেসে উঠলো পরী― তুমার মা তো সেই কুন ছোটবেলায় তুমাকে ফেলে রেখে ভেগেছে।সে এল ক‍্যামনে?
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বিজুর নতুন মা।বললেন ―বিজু আমাকে মা ডেকেছে।তাই ও আমার ধর্মছেলে। বিজুর কাছে আসার আগেই, আমার সবকিছু চুরি হয়ে গেছে।তাই আমি আবার পরবো বলে,আমার ছেলে আমার পরনের কাপড়টাই কেচে দিয়েছে।তা তুমি কে হও মা বিজুর?
শাড়ির বদলে ধুতি পরে,ও গামছা গায়ে দিয়ে থাকলেও, ভদ্রমহিলার চেহারার সম্ভ্রান্ততা দৃষ্টি এড়ায়নি পরীর।শুধু তাই নয়,হাতের সোনার রুলি দুটোও প্রমান দিচ্ছে কিছুটা।
পরী সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল―আমি পাড়াতেই থাকি।আমার ঠাকুমা মানুষ করেছে ওই বিজুকে।
বিজু বলল―তাতে তুর কি?তুই তো আমাকে মানুষ করিস লাই?
পরী বলল―আমি করিনি তো কি হয়েছে।আমার ঠাকুমা তো করেছে।
ওদের খুনসুটি অন‍্যদিনের মতো বেশিদূর গড়ালো না।উঠোনে এসে দাঁড়ালো ডাক্তার দীনেশ মুখার্জীর বাড়ির কাজের লোক।সঙ্গের ব‍্যাগটা মাটির দাওয়ায় নামিয়ে রেখে সে বিজুর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল―ডাক্তারবাবু দিয়েছেন।
পরী বিজুর পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো―ওটা আমায় দে।তুমি তো উটা পড়তে পারবেক লাই।
বিজু ফুঁসে উঠলো― খবরদার হাত দিবি লাই।আমি পারিলা,কিন্তুক আমার মা পারে।
চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বিজু তাকিয়ে রইল ওর নতুন মায়ের মুখের দিকে।
     আলপনাদেবী নিজের ঠিকানা,নাম না বললেও ডাক্তার মুখার্জীকে চলে আসার আগের মুহুর্তে  টাইটেলটা বলেছিলেন।ডাক্তার মুখার্জী চিঠিটা লিখেছেন আলপনাদেবীকে সম্বোধন করেই
 মিসেস ভট্টাচার্য,
      বিজুর মতো অত বড় মন আমার নেই।তবু মানুষ  তো।তাই আপনার এই অসময়ে আপনার পাশে থাকার সামান্য বাসনা জাগলো।আপনার কথা জেনে,আমার স্ত্রী আপনার ব‍্যবহারের জন্য কিছু জামাকাপড় পাঠালেন।দয়া করে ওগুলো গ্ৰহণ করলে, আমরা বাধিত হব।
                       শুভেচ্ছান্তে― দীনেশ মুখার্জী
চিঠিটা মাথায় ঠেকিয়ে আলপনা দেবী বললেন
― প‍্যাকেটটা দে তো বিজু।এবার একটু কাপড়টা পাল্টে নিই।
পরী প‍্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে গেল― এই নাও মা।তুমি কাপড় পরো।আমি তোমাদের জন্য চা করে দিচ্ছি।
আলপনা বললেন―বাঃ তুমি তো বেশ ভালভাবে কথা বলতে পারো।
পরী বলল―আমি হাই-ইস্কুলে পড়েছি কমাস।
― ঠিক আছে। তুমি যখন মা বলে ডেকেছো, তোমাকে আমিও মেয়ের মতোই ভাববো।
পরী কেরোসিন স্টোভে চা বসিয়ে বলল―তোমার যা ইচ্ছা মা তাই ভেবো।আমাকে পরী বলে ডেকো এখন।পরে বৌমা বলবে।আমার শুনতে খুব ভালো লাগে।
বিজু কটমট করে তাকালো―তুমি ওকে পাত্তা দিবেক লাই মা।ও বহুৎ পাজি।আমি চারডি ভাত খেয়ে শ্মশানে যাবো।তুমি সামলে থিকো ।
ওদের কীর্তিকলাপ দেখে মুখটিপে একটু হাসলেন আলপনা।বহুদিন পর এই সহজ সরল মানুষগুলোর কাছে এসে যেন প্রানভরে নিঃশ্বাস নিলেন।
     দুদিন যেতে না যেতে গ্ৰামের মানুষেরা জেনে গেছে, বিজুর দূরসম্পর্কের এক বিধবা মাসি বিজুর বাড়ি এসে আছে।তার তিনকুলে কেউ নেই বলে,বিজুকে ধর্মছেলে করেছে।বিজুর কাছেই থাকবে সে।ব‍্যাস,এইপর্যন্তই।ডোমপাড়ার ভেতরে কি হচ্ছে তার খোঁজ নিতে আগ্ৰহ নেই উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষদের।আর ডোমপাড়ার মানুষদের হাতে এত সময় নেই।নিজেদের গ্ৰাসোচ্ছাদনের জন্যে হন‍্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে হয় সকলকেই সারাদিন।
      *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      চারমাস পেরিয়ে গেছে। বিজু ডোমের অভাবের
সংসারে জলখাবারে দুমুঠো মুড়ি আর দুবেলা এক তরকারি ভাত খেয়ে পরম শান্তিতে আছেন আলপনা।এই তিনমাসে একটু একটু করে অনেক উন্নতি হয়েছে বিজুর।মা অন্তপ্রাণ বিজু ভালভাবে কথা বলতে শিখেছে মায়ের কাছে।এখন ও ‛ন‛কে ‛ল’বলে না।অক্ষর পরিচয় হয়েছে তার। নাম,ঠিকানা লিখতে শিখেছে।নিজের ‛বিজয়’ নামটার সঙ্গে নতুন করে পরিচিতিও হয়েছে তার।এতে খুশি শুধু আলপনাদেবীই নন,খুশি পরীও।
     পরী আসে দুবেলা।ডানপিটে মেয়েটা অনেক শান্ত ভদ্র হয়েছে।আলপনাকে খুব যত্ন করে মেয়েটা।তাই দেখে পরীর প্রতি বিজুর মন একটু একটু করে নরম হচ্ছে।আলপনা পরীকে বলেছেন, তিনি পরীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন।তবে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।বিজু একটু গুছিয়ে নিলেই বিয়েটা হবে।পরীও তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো অপেক্ষা করে চলেছে।
      আজ সকাল সকাল স্নান সেরে রান্না বসিয়েছেন আলপনা।বিজু গঙ্গার ধার থেকে ইলিশমাছ কিনে এনে কাটছে।পরী ঘরদুটো পরিস্কার করে,উঠোনটা নিকিয়ে,স্নান করে এসেছে।এখন শিলে মশলা বাঁটছে।সবই বিশেষ অতিথির জন্য।সকাল ন’টা বাজতেই বিজুর বেড়ার দরজার সামনে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
      গাড়ি থেকে নামলেন একজন ধোপদুরস্ত পোশাক পরা ষাটোর্ধ্ব মানুষ।ভদ্রলোক চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন ―এত কৃচ্ছসাধন কেন করছেন মিসেস ভট্টাচার্য?বৌমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট যে হবেনা সেটা বুঝতে পেরেছিলাম সঞ্জয়ের বিয়ের পরই।কিন্তু আপনি তো কোন ভালো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারতেন।সেটা না করে,নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন কেন?
ম্লান হাসলেন আলপনা― মিঃ বসু,আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরটা নিশ্চয় সঞ্জয়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন?
―হ‍্যাঁ।আমি কলকাতায় ফিরেই,প্রতিবারের মতো খোঁজ করেতে গিয়েছিলাম আপনার।সঞ্জয় বলল ―মা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে কোথায় চলে গেছে।অনেক খুঁজেও পাইনি।
ও যাই বলুক,আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল,আপনি আমাকে কিছু জানাবেন।তবে যে সাতদিন কলকাতায় ছিলাম, তারমধ্যে কোন খবর না পেয়ে আশাহত হয়েছিলাম।
আলপনাদেবী বললেন―মিঃ বসু,আমার কথা আজ আমি বলব না।বলবেন অন‍্য একজন।এসেছেন যখন,তখন দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন।
সুবিমল বসু বললেন― বিশ্বাস করুন, আপনার সেদিনের টেলিফোনটা পেয়ে আমি সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার দুদিন আগেই আমাকে চলে যেতে হয়েছিল দিল্লি।এই তিনমাস আমার ওখান থেকে আসার কোন পথ ছিল না।সব কাজ মিটতেই, তৎকাল কেটে চলে এসেছি কাল।আর আজ আপনার দেওয়া ঠিকানায়।
      বারান্দার একদিকে রাখা সতরঞ্জি পাতা কাঠের বেঞ্চটায় মিঃ বসুকে বসতে অনুরোধ করলেন আলপনাদেবী। পরী একটা কাঁচের গ্লাসে সরবত এনে দিল।মিঃ সুবিমল বসু গ্লাসটা ধরতে সংকোচ করছিলেন দেখে আলপনাদেবী বললেন―আমরা জাতে ডোম হলেও, সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।আপনি স্বচ্ছন্দে সরবতটা খেতে পারেন।
লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরবতের গ্লাসটা ধরে চুমুক দিলেন মিঃ সুবিমল বসু।
আলপনা বললেন―জানেন মিঃ বসু! আমি লাভ -লোকসানের হিসাবটা হয়তো সঠিক করতে পারিনা।তবে একটা কথা আপনাকে বলতে পারি। জীবনে এত সুখ,এত শান্তি,এত ভালবাসা আমি কখনো পাইনি।সত্যিই এ যেন আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
     বাইক থেকে উঠোনে রেখে, এগিয়ে আসতে আসতে ডাঃ দীনেশ মুখার্জী বললেন―সেটা তো মনে হবেই।কারণ এখন আপনি অন‍্য কারো মা নন, বিজুর মা।ওর সর্বশক্তি দিয়ে, ও খুশিতে রাখতে চায় আপনাকে।তবে আজকে আমার মনটাও বেশ খুশি খুশি বিজুর কাছ থেকে মধ‍্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণটা পেয়ে।বিজুর মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার লোভটা তো কিছু কম নয়?
কথাটা বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন ডাঃ দীনেশ মুখার্জী।




      *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      আলপনাদেবীর স্বামী-সোমনাথ ভট্টাচার্য ও সুবিমল বসুর বন্ধুত্ব পাঁচবছর বয়স থেকে।সোমনাথ যতদিন বেঁচেছিলেন,ততদিন পর্যন্ত ওঁদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল।দুজনেই দুজনকে সাংঘাতিকরকম বিশ্বাস করতেন।পঞ্চান্ন বছর বয়সে যখন সোমনাথ ভট্টাচার্যের বুকে প্রেসমেকার বসে,তখনই উনি আলপনাদেবীর ভবিষ‍্যতের কথা ভেবে, ছেলেকে লুকিয়ে দুটো কাজ করে যান।বৌবাজার এলাকায় স্ত্রীর নামে একটা বাড়ি কেনেন।আর চোদ্দ পনেরো ভরির মতো গহনাও কেনেন। সেই বাড়ির দলিল ও গহনা রেখে দেন সুবিমল বসুর কাছে।
     বাষট্টি বছর বয়সে সোমনাথ ভট্টাচার্যের যখন মৃত্যু হয়,তখন আলপনাদেবীর বয়স চুয়ান্ন।ছেলে,  সঞ্জয়ের সদ‍্য বিয়ে হয়েছে।নতুন বৌমার হাবভাব মোটেই ভাললাগেনি সুবিমল বসুর।মনে হয়েছিল, বড্ড উদ্ধত।তখনই সুবিমল বসু আলপনাদেবীকে একান্তে ডেকে একদিন জানিয়েছিলেন, বাড়ি ও গহনার কথা।সেদিন আলপনাদেবী বলেছিলেন, “ওনিয়ে আপনি চিন্তা করবেননা।যেদিন দরকার পড়বে, সেদিন বলব।এখন আপনার জিম্মায় থাক সব।”এরপর পেরিয়ে গেছে চারটে বছর।
     আলপনা দেবীর ঘরের চৌকিটায় একটা ভাল চাদর বাড়ি থেকে এনে বিছিয়ে দিয়েছে পরী।ওই ঘরেই কথা বলতে ঢুকলেন দুজনে।ডাঃ দীনেশ মুখার্জী বললেন কিভাবে উদ্ধার করেছিল বিজু আলপনাদেবীকে।তারপর কিভাবে সুস্থ করা হয় তাঁকে।এছাড়া আলপনাদেবীর কাছে সেই রাত্রে শোনা কথাগুলোও জানালেন।
আলপনাদেবী ঘরে ঢুকতেই সুবিমল বসু বললেন
 ―এটা কিন্তু আপনি ঠিক করলেননা মিসেস ভট্টাচার্য।আপনি অতবড় অপরাধী দুজনকে ছেড়ে দিলেন?এভাবে সমাজে অপরাধ তো বাড়বে।
আলপনা বললেন― আমি আজ সমাজ- সংসারের কথা ভাবতে অপারক।তাছাড়া কি হতো পুলিশকেস হলে?কি হতো ওরা জেল খাটলে?কি হতো আমি আমার হৃত সম্পত্তি ফিরে পেলে?আলটিমেটলি কিচ্ছু হতো না মিঃ বসু।দুটো ছোট ছোট বাচ্ছাকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিতে পারতাম না আমি।ওদের দায়িত্ব কে নিতো?কেস চললে, সেখানেও ছুটতে হতো আমাকে।কিন্তু সবকিছুর পর ভেঙ্গে যাওয়া মনটা কি জোড়া লাগতো?লাগতো না।তার থেকে আমি অনেক শান্তিতে আছি আত্মগোপন করে এখানে থেকে।আমার আজ একটাই পরিচয়,আমি বিজু ডোমের মা।এটা ভাবলে আমার ভাললাগে।
মিঃ সুবিমল বসু বললেন― আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন।আমি টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলাম দিল্লি থেকেই।বাড়িটার খদ্দের পাওয়া গেছে একজন।ও গতকাল কথা বলেছে।পুরোনো বাড়ি।তাই পঁয়ত্রিশ লক্ষ্যের বেশি দিতে চাইছে না।আপনাকে অথরিটি লেটারে সাইন করে দিতে হবে।আর আপনার অর্নামেন্টগুলো নিয়ে এসেছি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার বাড়ি বিক্রির টাকা আপনাকে পৌঁছে দিয়ে,আমি দায়মুক্ত হব।
       দুখানা বেঞ্চ সামানাসামনি রেখে খেতে দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা করে দিয়েছে বিজু।সেখানে বসে পরম তৃপ্তি সহকারে মধ‍্যাহ্নভোজ সারলেন সদর হাসপাতালের ডাক্তার দীনেশ মুখার্জী ও কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মিঃ সুবিমল বসু।
        *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      বিজুর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে মাত্র একটা বছরে।অবশ‍্য সবই সম্ভব হয়েছে তার নতুন মায়ের আনুকূল্যে।সুবিমল বসু দিনকুড়ির মধ্যেই বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন আলপনাদেবীর হাতে।নতুন করে পাওয়া ছেলে–বিজুর জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতে, তাকে একটা ভালো জীবন দিতে, ভীষণভাবে আগ্ৰহী হয়ে উঠেছিলেন আলপনাদেবী।ঠিক এইকারণেই এতটুকু কার্পণ্য করেননি তিনি অর্থ ব‍্যয় করতে।বিজুর বড় উঠোনের ফাঁকা জায়গাটায় তিনকুঠুরি পাকাঘর তৈরী হয়েছে।বিজু দাহকার্য ছেড়ে,কাঠের ব‍্যবসা শুরু করেছে।সঙ্গে সঙ্গে পরীও এবাড়িতে এসেছে বিজুর বৌ হয়ে।
       বাহ‍্যিকভাবে পরিবর্তন হলেও, বিজুর মনের কোন পরিবর্তন হয়নি।এই পাকাবাড়ি,এই ব‍্যবসা, পরীর মতো সুশ্রী বৌ–এসব কোন পাওয়াকেই বড় করে দেখেনা বিজু।ওর জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া ওর মা।তবে একটা ব‍্যাপারে অবশ‍্য খুব খুশী বিজু।পরী খুব যত্ন করে ওর মাকে।বিজুর মতোই অন্তর থেকে ভালবাসে তাঁকে।মেয়েটারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।লোভকে জয় করতে শিখেছে সেও বিজুর মতো। তাইতো আলপনা যখন তাকে অনেক গয়না দিতে চেয়েছিলেন, তখন সে নেয়নি সেগুলো।বলেছিল―তোমার পছন্দমতো শুধু একটা গয়না দাও আমাকে মা।বাকিগুলো রেখে দাও তোমার নিজের জন্যে।কখন কি কাজে লাগে,তার কি ঠিক আছে?
কথাটা শুনে আলপনা মনে মনে ভেবেছিলেন,এই তো বিজুর উপযুক্ত বৌ।
       আলপনা যখন একা থাকেন,তখন অনেক কিছু মনেপড়ে।সত্যিই কি বিচিত্র এই দুনিয়া।যে ছেলেকে একবছর বয়স থেকে বুকে আগলে রেখে বড় করলেন,যে উপযুক্ত শিক্ষা পেলো,সে কত নির্মম হতে পারলো।অথচ একটা অশিক্ষিত ছেলে যার নিজের পেট চলতো কোনরকমে,সে কেমন অবলীলায় বলেছিল―আমার ভাতটো দুজনে ভাগ করে খাবো।
      *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
      আলপনাদেবী বিজু ডোমের ভিটেয় আসার পর,পেরিয়ে গেছে বাইশটা বছর।ছাপান্ন বছরের আলপনাদেবীর বয়স এখন আটাত্তর। ছেলে, বৌমা নাতি, নাতনি সকলকে নিয়ে ভরা সংসার আলপনাদেবীর।বিজুর ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে।ঠাম্মা অন্তপ্রাণ দুজনেই।সকলের আদরযত্নে ভালভাবেই কেটে যাচ্ছে তাঁর শেষজীবনটা।
      দুবছর আগে পর্যন্ত সুবিমল বসুর সঙ্গে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর।দশবছর আগে সুবিমল বসু যেদিন আলপনাদেবীকে সৎছেলের অ্যাকসিডেন্টে একটা পা হারানোর সংবাদটা দিয়েছিলেন,সেদিন খুব কেঁদেছিলেন আলপনা।তারপর মনকে বুঝিয়েছিলেন যে তাঁর কেউ নয়,তার জন্যে কেন কাঁদবেন তিনি।তাঁর তো ছেলের মতো ছেলে আছে।শুধু বিজুকে নিয়েই তিনি পেয়েছেন সন্তানসুখ।তাই তারই কথা ভাববেন তিনি।




      গতবছর মারা গেছেন সুবিমল বসু।তাঁর ছেলে খবরটা দিয়েছিল আলপনাদেবীকে।খুব ইচ্ছা করছিল তাঁর,সেসময় সুবিমলের স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে।কিন্তু পারেননি আলপনা।আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সবাই যাকে মৃত বলে জানে,তিনি কিকরে দাঁড়াবেন তাদের সকলের সামনে।তাই মনে মনে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেছিলেন সেই মহৎ মানুষটার উদ্দেশ্যে।
      পুজোপাঠ শেষ করে উঠেই আলপনাদেবী শুয়ে পড়লেন খাটে।পরী জলখাবার খাওয়ার জন্যে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে ঘরে ঢুকলো।দেখলো বুকের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে আছেন আলপনা বড় বড় শ্বাস পড়ছে।ভালো করে কথা বলতে পারছেন না তিনি।জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন “বিজু” …
পরী ছেলেকে বলল―আজ তোকে কলেজ যেতে হবেনা।তুই এক্ষুনি ডাক্তারদাদুকে ডেকে নিয়ে আয়।মেয়েকে বলল―তোর বাবাকে ফোন কর।
ছেলে বেরিয়ে যেতেই পরী আলপনাদেবীর বুকে হাত বোলাতে লাগল। অসহায়ের মতো কেঁদে চলেছে পরী।বুঝতে পারছেনা এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ।
       ডাঃ দীনেশ মুখার্জীর বয়স বাহত্তর হলেও, চিকিৎসা করা বন্ধ করেননি। নিয়মিত প‍্যকটিস করেন গ্ৰামের নিজস্ব চেম্বারে।খবরটা পেয়েই উনি চেম্বার ছেড়ে উঠে এসেছেন।বিজুও বাড়ি ঢুকেছে হাঁপাতে হাঁপাতে।ডাক্তার মুখার্জী পরীক্ষা করলেন আলপনাদেবীকে।তারপর বললেন– বিজু,তোর মায়ের মুখে জল দে।
মুখে জলটুকু দিয়েই বিজু আলপনাদেবীর বুকের ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
দীনেশ মুখার্জী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন,কি অপূর্ব একটা প্রশান্তি বিরাজ করছে মৃত আলপনা ভট্টাচার্যের মুখমণ্ডল জুড়ে।
     মাকে কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গেলেও সেখানে দাঁড়াতে পারছেনা বিজু।মুখাগ্নি করার জন্যে সবাই ধরে নিয়ে এসেছে বিজুকে।সকলের অনেক চেষ্টার পর মুখে আগুন দিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিজু।চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিজু মুখাগ্নি করছে ―তোমরা সব্বাই দেখো,আজ বিজু ডোমের মা টা মরে গেছে। বিজু ডোম নিজের মায়ের চিতায় আগুন দিচ্ছে।আজ থেকে বিজু ডোম আর মা বলে কাউকে ডাকতে পারবে না।
আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা বিজুর সেই চিৎকার, সেই বিলাপধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত শশ্মান- চত্ত্বরে।

           

Share This Article