যদিদং হৃদয়ং তব – Golpo Bangla – Bengali Love story – Premer golpo

Bongconnection Original Published
8 Min Read
যদিদং হৃদয়ং তব - Golpo Bangla - Bengali Love story - Premer golpo
Loading...

   
                          কলমে – শ্রেষ্ঠা দত্ত 

শনিবারেও কাজের কোনো অন্ত নেই, কর্পোরেট জগতে এই এক মুস্কিল।সবসময় যেন প্রতিযোগিতার ইদুর দৌড় চলছে।কোনোমতে ম্যানেজ করে অফিস থেকে বেরিয়ে হাতঘড়িটার দিকে তাকায় অমিত,না সময় ঠিকঠাকই আছে সাড়ে চারটে বাজে এখন।সল্টলেক থেকে ছটার মধ্যে ওই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যাবে যতই রাস্তাঘাটে হালকা জ্যাম থাকুক না কেনো!সবেমাত্র একটা ক্যাব ট্যাক্সিতে উঠে বসেছে ও,সাথে সাথেই মায়ের ফোন।এদিক থেকে ফোনটা ধরতেই ভেসে আসে মা সুপর্ণাদেবীর উদ্বিগ্ন সুর,”কিরে অমিত বেরিয়েছিস তো অফিস থেকে?দেখিস বাবা দেরী করিসনা যেনো।আমি কিন্তু ওদের ফোনে বলে দিয়েছি যে আমরা পাক্কা ছটার মধ্যে পৌঁছাবো ওখানে তোকে নিয়ে।সেই বুঝে আসিস কিন্তু।”

__”হ্যাঁ জানি মা,অফিস থেকে বেরিয়ে অ্যাপ ক্যাব ধরে নিয়েছি আমি।তুমি আর বাবা ঠিক সময় পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকো আমি ওখান থেকেই তোমাকে পিক আপ করে নেবো।”ছেলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ফোনটা রেখে দেন সুপর্ণাদেবী।ওনার হয়েছে এই এক সমস্যা।ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলেন।এদিকে অমিত
এমনই ছেলে কাউকে এতদিনে নিজে পছন্দ তো করতেই পারলনা উল্টে ওর অনেক হ্যাপা।
অমিত নিজে সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। সেই শিক্ষা দীক্ষা আদলে নিজেকে গড়ে তুলেছে ছোটবেলা থেকেই।বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান,কবিতা অমিতকে আকর্ষণ করে।ওদের বন্ধুদের একটা নিজস্ব গানের দলও আছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যেখানে ওরা গান বাজনা নিতে চর্চা করে যখনই সময় পায়।সেইরকম একজনকেই জীবনসঙ্গিনী চাইছে অমিত যে এই দিকটা বুঝবে।কিন্তু আজ পর্যন্ত সেরকম কাউকে পাওয়া গেলনা।যা দেখেছে তাতে চক্ষু চড়কগাছ হবার যোগাড়।ঘটক বা চেনাপরিচিতের মাধ্যমে যে কয়েক জায়গায় আজ পর্যন্ত পাত্রী দেখতে গেছে তারা ওই গলা ফুলিয়ে হয় আবৃত্তি শুরু করেছে নতুবা হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসেছে “এসো প্রাণ ভরন হৃদয় হরণ হে।”

কিন্তু দু এক কলি শোনার পর আর শোনার ইচ্ছা হয়নি অমিতের।বিয়ের বাজারে অবশ্য সব ঘটকই বলে তাদের এনে দেওয়া পাত্রীই সেরা পাত্রী।কাহাতক আর এই উটকো ঝামেলা ভালোলাগে? মাঝেমধ্যেই অমিতের মনে হয় এর থেকে ব্যাচেলর লাইফ অনেক ভালো কিন্তু ওর মাতৃদেবী নাছোড়বান্দা।ওর মত বাউন্ডুলে ছেলের বিয়ে না দিয়ে তিনি পৃথিবী ছাড়বেন না এটা অমিতের কাছে ওর মায়ের দৃঢ় অঙ্গীকার।তাই এবারের গন্তব্য সোনারপুর।ওখানে নাকি একটি মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে নাকি এসব গুণ আছে যা অমিতের পছন্দ।ওর মার দূরসম্পর্কের রাঙ্গা বৌদি সম্মন্ধ ঠিক করেছেন।

পাত্রীর বাড়ি যথাসময়ে উপস্থিত হলেন ওনারা।উপরি আয়োজন তো ঠিকঠাকই আছে।কিন্তু যে কারণে আসা তিনি অর্থাৎ পাত্রী কই?শোনা গেল পাত্রী লাবণ্যর অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আসছে।যাক বাবা মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে অমিত।অন্তত সেই প্রচন্ডভাবে চড়া মেক আপের চাকচিক্যটা থাকবেনা।অমিতের কাছে অন্তরের রূপটাই সব।কেন যে বিয়ের জন্য
পাত্রীপক্ষরা নিজেকে ওতো সাজিয়ে গুছিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থাপনা করতে চায়!সমাজের এসব প্রচলিত প্রথা কবে যে ভাঙ্গবে কে জানে??

এইসব ভাবনার মধ্যেই লাবণ্য মানে পাত্রীর প্রবেশ ঘটল।কিন্তু এ কাকে দেখছে অমিত ওর চোখের সামনে??এতো সেই মিস চিংড়িঘাটা!

রাগে চোয়ালটা কঠিন হয়ে ওঠে অমিতের।মেয়েটি বলে,” আরে আপনি এখানে?”অমিত সামান্য ঢোক গিলে বলে,”হ্যাঁ সেটাই বলছিলাম আপনিই এখানে?”

ওদের হাবভাব দেখে বাড়ির বড়রা জিজ্ঞাসা করেন,”কিরে দুজন দুজন কে চিনিস নাকি আগে থেকে?”

অমিত মনেমনে ভাবে চেনে না মানে!হাড়ে হাড়ে চেনে ও এই তরুণীকে।ওর মনে পড়ে যায় গতবছরের সেই ঘটনা।একটা বৃষ্টির দিনে অফিস থেকে ফিরছিল অমিত।কলকাতার পাবলিক বাসে এমনিই যা ভিড় তার উপর আবার বৃষ্টি। সব মিলিয়ে চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা।ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছেনা পর্যন্ত এই অবস্থায় ড্রাইভার বাবাজীবন মারলেন এক আইসা ব্রেক হুমড়ি খেয়ে এ ওর ঘাড়ে।ব্যাস অমনি ধেয়ে এল বাক্যবাণ।অমিত যতই সরি বলে কিন্তু এই মেয়েটি শুনবেনা।উফ আচ্ছা নাছোড়বান্দা টেটিয়া মেয়ে তো?চিংড়িঘাটার মোড়ের ঘটনা বলে পরে অমিতের বন্ধুরা পরে মজা করে ওর নাম দিয়েছিল মিস
চিংড়িঘাটা।এহেন জাঁদরেল মেয়ে ওর বৌ হবে?শেষ পর্যন্ত কিনা এর সাথেই বিয়ের কথা?নিজেকে সামলে অমিত মনে মনে ঠিক করে নেয় যাতে প্রশ্নোত্তর পর্বে  লাবণ্যকে ভালোমত ঘোল খাইয়ে দিতে পারে।

সবাই বলে,”যা তোরা একটু আলাদা কথা বলে নে। দুজন দুজনকে চেনা জানাটা খুব দরকার।”

ব্যাস এইবার বাগে পাওয়া গেছে মিস চিংড়িঘাটা থুড়ি লাবণ্যকে।ছাদে চলে আসে দুজন।অমিত জিজ্ঞাসা করে,” আপনার নাম তো লাবণ্য,তা আপনি রবীন্দ্রনাথের কোন সৃষ্টির চরিত্র আপনি জানেন কি?আসলে রবিঠাকুর আমার খুব প্রিয় চরিত্র তাই আপনার নামটা জেনে একটু জিজ্ঞাসা করলাম এই আর কি।”

লাবণ্য প্রথমে একটু চুপচাপ থাকে আর ভিতরে ভিতরে খুশি হয় অমিত।উফ আচ্ছা জব্দ হবে এবার লাবণ্যদেবী!ওকে এমনসময় অবাক করে দিয় লাবণ্য বলতে শুরু করে,” দেখুন মানসিকতার দিক থেকে বলতে গেলে এভাবে বিয়ের জন্য ইন্টারভিউ দেওয়া আমার ঠিক পছন্দ না।একটা মেয়েকে বিয়ের জন্য নিজেকে  সাজিয়ে গুছিয়ে এতকিছু প্রশ্ন উত্তর পর্বের মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা খুবই বিরক্তিকর।প্রত্যেকটা মানুষের একটা আত্মসম্মান আছে আর মেয়েদেরও সেটা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।আসলে আমার আগে জানা ছিলনা আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। এর আগে কয়েক জন পাত্রপক্ষ আমার সোজাসাপ্টা কথা শুনে বিয়ের কথা মুলতুবি রেখে কেটে পড়েছেন কিনা তাই এবার আর আমাকে কিছু জানানো হয়নি।একবারে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম।তাই আমার মা বাবার অপমান হোক আমি চাইনা, ওনাদের কথায় আপনারা আজ এসেছেন।”




অমিতের এবার চক্ষু চড়কগাছ!তবে কি লাবণ্য অন্য কাউকে ভালোবাসে? এসব বলে ভাগিয়ে দিতে চাইছে?অমিত কিছু একটা বলতে যায় ওকে।কিন্তু অমিতকে থামিয়ে দিয়ে লাবণ্য আবার বলে,”দেখুন অমিতবাবু আজ আপনি আমাদের অতিথি।তাই আপনারও কোনো আত্মমর্যাদার হানি হোক আমি চাইনা।আপনি রবিঠাকুরের কথা জানতে চাইছিলেন তাইনা?”তবে বলি রবিঠাকুর আমার প্রাণের ঠাকুর।আমার ঠাকুর্দা শান্তিনিকেতনে পড়াতেন;রাবীন্দ্রিক আদর্শেই দীক্ষিত ছিলেন আমার ঠাকুর্দা।রবি ঠাকুরের লেখা “শেষের কবিতা” ওনার খুব প্রিয় ছিল। তাই আমার নাম রেখেছিলেন লাবণ্য।আর আমিও চাই আমার জীবনে সেই লাবণ্যের নির্যাসটা উপভোগ করতে। তাই খুব সকালে উঠে যেমন গাইতে পারি,”এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়” তেমনি ঘনোঘর বর্ষাতে,”মন মোর মেঘের সঙ্গী।” আবার খুব মনখারাপ করলে রাত্রে ঘরের সব আলো নিভিয়ে,”যে রাতে মোর দুয়ারগুলি।”
আসলে কি বলুন তো  জীবনে মননে প্রকৃতিতে রবিঠাকুর মিশে আছেন।তাই শুধু বিশেষ দিনে নয় প্রতিদিন যেমন রবি(সূর্য) উদিত হয় ঠিক তেমনই রবিঠাকুরের উপস্থিতিও প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে।”

মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর কথাগুলো শুনছিল অমিত।বলে কি মেয়েটা?এত সহজ করে রবিঠাকুরকে বুঝিয়ে দেওয়া এত সাধারণ কাজ নয়।

__”কি ভাবছেন এত? না বোঝার মত কিছু বললাম কি?দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন আপনি দেখছি।”লাবণ্যের কথায় হুশ ফেরে অমিতের।লাবণ্য আবারও বলে,”দুঃখিত সেদিনকার ঘটনার জন্যে। ক্ষমা করবেন অতটা রিএক্ট করা বোধয় উচিত হয়নি আমার।আস্তে আস্তে অমিত বলে চলুন যাওয়া যাক নীচে সবাই অপেক্ষা করছে।” নীরবতা ভেঙে অমিত বলে,”সেদিনকার ঘটনার জন্য আমিও লজ্জিত।পারলে নিজগুণে মাফ করবেন। আর অনুরোধ মান অভিমানগুলো মিটিয়ে নেবার সুযোগটা কি পাওয়া যাবে ম্যাডাম?”

মুচকি হাসে লাবণ্য।ওদের দুজনের  হাবভাবটাই বলে দিচ্ছিল অভিমানের মেঘ কেটে গেছে।এখন শুধু ভালবাসার বৃষ্টি নামার অপেক্ষা।ফেরার পথে গাড়িতে অমিতের মুখে নীরব হাসিটা দেখেই ওর মা সুপর্ণাদেবী বুঝে গেছিলেন ছেলের পাত্রী পছন্দ।মুঠোফোনটা স্পর্শ করে অমিত।আঙ্গুলের হালকা ছোয়াতে ভেসে ওঠে রবিঠাকুরের একটি গানের কয়েক কলি
“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে/
আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জিরে।”

সামনের বৈশাখে কবি প্রণামের অনুষ্ঠানে কিন্তু একসাথেই গান গাইবো দুজনে।আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম লাবণ্য।এই বলে সিটে গা এলিয়ে দেয়।

কিছুক্ষন পর মুঠোফোনে সুরেলা বার্তা আসার শব্দে চোখ মেলে অমিত।লাবণ্য লিখে পাঠিয়েছে,”আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই গো।”
যাক নিশ্চিন্ত অবশেষে অমিত লাবণ্যের বিয়ের ফুলটা ফুটলো তাহলে।

Share This Article