লিখেছেন – পুষ্পিতা ভৌমিক
আদিবাসী লোকজনের কণ্ঠে “হোলি হ্যায়” শব্দে আজ অন্যদিনের তুলনায় অনেক সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙে যায় রুপমের।গাটা বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে,গতকাল আসা জ্বরটা এখনও ছাড়েনি পুরোপুরি।অগত্যা পাতলা চাদরটা জড়িয়ে বিছানায় বসে বসেই জানলা দিয়ে চোখ চলে যায় ওর।অদূরেই দিগন্ত আলো করে ফুটে থাকা পলাশ কৃষ্ণচূড়াদের দিকে তাকিয়ে মনটা আনমনা হয়ে যায় রুপমের।এই লালমাটির দেশের একটা আলাদা মাদকতা আছে বিশেষ করে এই সময়টায়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একটা ধিমি ধিমি মাদলের সুর বাজতে থাকে বুকের ভিতর।সেই সাথে আজকের দোলের বিশেষ দিনে মনটাও একটু খারাপ হয়ে যায় ওই বাড়ির কথা ভেবে,এই প্রথম দোলের দিন সবাইকে ছেড়ে ও একা রয়েছে বহুদূরে।কলকাতা শহরের উপকন্ঠে সোনারপুরে ওদের বাড়িতে পরিবারের সকলে মিলে কত আনন্দ হয় আজকের দিনে সব ভাইবোনরা একজোট হয়ে।ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে প্রথমে গুরুজনদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম,তারপর ভাইবোনদের সাথে পিচকিরি খেলা,বাঁদুরে রং মাখানো আর সেই সাথে ঠাকুমার হাতে বানানো নারকেল নাড়ু আর শরবৎ।
আর সেই সাথে পাশের বাড়ির বিয়াসের সাথে কাটানো ভালোলাগার মুহূর্তগুলো তো আছেই।সেই কোন ছোটবেলা থেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিয়াসের সাথে ব্যাডমিন্টন,ডাংগুলি খেলতে খেলতে প্রথম বর্ষে পা দিয়ে রুপমের একটু অন্যরকম মনে হয়েছিল একাদশ শ্রেণীর মেয়েটাকে এই দোলের দিন। লাল আবিরে রাঙিয়ে দিয়েছিল ওর সিঁথি চিলেকোঠার ঘরে।ধ্যাত অসভ্য বলে লজ্জা পেয়ে পালাতে গিয়ে রুপমের ঠাকুমার কাছে ধরা পড়েছিল বিয়াস।তারপর দুজন মিলে আদরের কানমলাটাও খেয়েছিল দুজন মিলেই। ভাবনাই সার এইবার এইসব কিছু থেকে বঞ্চিত রুপম। ভারতীয় ডাকবিভাগে চাকরি পেয়ে পুরুলিয়ার এই গ্রামে মাস তিন হল এসছে ও।আর শরীরটাও বাধ সেধেছে নাহলে না হয় দিন দুই বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসা যেতো।আজ ওর এই আবাসনে আদিবাসী বৃদ্ধা মহিলাও কাজে আসবেনা মনে হয়।ওদের কাছে এটা যে বড় উৎসব।সাতপাঁচ না ভেবে রান্নাঘরে যায় রুপম।ঝটপট মাথা ছাড়াবার জন্য একটু আদা চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসে।ওর আবাসনের সামনের রাস্তা রঙিন হয়ে গেছে আবিরে আবিরে।রুপম ওর মুঠোফোনে নেট চালু করতেই ভেসে ওঠে একের পর বন্ধুবান্ধবদের রঙের উৎসব উদযাপন করার ছবি।সেই সাথে ভাইবোনদের ট্যাগ করা বাড়ির দোলের ছবি তো আছেই।টুকটাক ছবিতে লাইক,কমেন্ট দিতে দিতেই মেসেঞ্জারে বিয়াসের বার্তা,”কি কেমন আছে তোমার?এবার তুমি বাড়ি ফিরলে কিন্তু তোমার রঙেই সাজবো।রংগুলো সব সযত্নে তুলে রাখলাম মনের গভীরে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।”রুপমের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায় এক আদিবাসী প্রেমিক যুগল।ওদের খিলখিলে হাসিতে যেন ঝরে পড়ে ঝরনা।ও টাইপ করে,”কিছু রং ছবিতে,কিছু রং কবিতায়,কিছু রং হাওয়ায় ভাসালাম/যত রং স্বপ্নের তোকেই ছুঁতে চায় সবটুকু তোকে দিলাম।”
কিছুক্ষণ পর শরীরটা ঝিমঝিম করতে থাকে রুপমের,না জ্বরটা আবার বাড়ছে বোধয়।একটা ওষুধ খেয়ে চেয়ারে বসে ও। এভাবে থাকতে থাকতে কতক্ষণ যে পেরিয়ে গেছে টের পায়না রুপম।হুশ ফেরে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে।ও তাকিয়ে দেখে বিয়াস দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
__”কি রে তুই এখানে আজকের দিনে?কই তখন তো কিছু বললিনা উল্টে বরং হেয়ালি করলি!কি দরকার ছিল এসবের?আমি এমনিতে ঠিক হয়ে যেতাম।”ঝাঁঝিয়ে উঠে রুপম বলে।
ভ্রূ নাচিয়ে বিয়াস বলে ,”হ্যাঁ আমি বলতেই চেয়েছিলাম তোমাকে যে আমি আসছি। কিন্তু তোমার ঠাকুমা বারণ করে বলল আগে থেকে কিছু বলার দরকার নেই হবু নাতবউ।তারচেয়ে একেবারে বরং দোলের দিন গিয়ে তোর কেষ্ট ঠাকুরকে একেবারে চমকে দে ওই যে কি বলে সারপ্রাইজ।আর আমার সঙ্গে ঠাকুমা কি পাঠালো দেখো। ওনার হাতে বানানো নাড়ু। তোমার ভালো না লাগলে ফিরে যাচ্ছি আবার বাড়ির গাড়িতে।”অভিমান ভুলে রুপম এবার হেসে ওঠে বলে,”যাক বাড়ি না গিয়ে ভালোই হয়েছে তাহলে কি বল!ভালোবাসার ওভারডোজ পেলাম এবার।একাধারে নাড়ু আর তোর ওই মিষ্টিমুখ।সত্যি ঠাকুমার কোনো জবাব নেই।” কপট রাগ দেখিয়ে বিয়াস বলে,”পেটুক একটা”।
জ্বরটা ছেড়ে গেছে পুরো। আবাসনের সামনে পড়ে থাকা পলাশ ফুল এনে বিয়াসের খোঁপায় লাগিয়ে দেয় ও। পালাতে চাইছিল বিয়াস রুপমের বাহুডোর থেকে।এক ঝটকায় নিজের ঘামে ভেজা হলুদ পাঞ্জাবিটার খুব কাছে বিয়াসকে টেনে নেয় রুপম। ওর সিঁথিতে ছুঁইয়ে দেয় আবিরের পরশ।তারপর গুনগুন করে গেয়ে ওঠে,
“বনে এমন ফুল ফুটেছে
মান করে থাকা আজ কি সাজে
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
চলো চলো কুঞ্জমাঝে।।।