আবার হাসি মুখ – Golpo Bangla – Bengali Story

Bongconnection Original Published
10 Min Read

আবার হাসি মুখ - Golpo Bangla - Bengali Story
Loading...




দেবরকে সেদিন নিজেই বলে ফেলেছিলাম “তুমি কি আমায় বিয়ে করতে পারো না? উত্তরে সে কিছুই বলে নি! চুপচাপ শুকনো মুখে চলে গিয়েছিল। তার চলে যাওয়াটা অবশ্য স্বাভাবিক। বাচ্চাওয়ালা কোনো মেয়েকে কে ই বা বিয়ে করতে চায়! কে চায় অযথা একগাদা দায়িত্বের ভার নিজের কাঁধে চাপাতে? পৃথিবীর সব ছেলেরাই চায় একজন শুদ্ধ কুমারী তার স্ত্রী হোক। যার শরীরে অন্যকোনো পুরুষের স্পর্শ নেই। আমার দেবর ও সেটাই চেয়েছিল। তার এই চাওয়াকে আমি দোষ দিতে পারি না।

কিন্তু আমি আমার দেবরকে কখনোই নির্লজ্জের মতো বিয়ের কথা বলতাম না। নিজের বিয়ের কথা নিজে বলা কোনো শালীনতার পর্যায়ে পড়ে না। বলেছি একরকম বাধ্য হয়ে। এই বাধ্য হওয়ার ব্যাপারটা তৈরী হয়েছে মায়া থেকে। একটা সংসারে একটানা চার বছর থাকার মায়া। চারটা বছর সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকার মায়া। সংসারটাকে নিজের মতো করে আগলে রাখার মায়া। সংসারের প্রতিটা মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিটা জিনিসের প্রতি আমার মায়া পড়ে গিয়েছিল। সে মায়া কাটবার নয়!
.
হাসান কে ভালোবেসে তার ঘরে বউ হয়ে এসেছিলাম। হাসান আমায় খুব ভালোবাসতো। কেউ কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না! খুব সুন্দরকরে গীটার বাজাতে পারতো সে। মধ্যরাতের ভরা জ্যোৎস্নায় আমরা ছাদে যেতাম। একসাথে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখতাম। আকাশের বুকে কালো মেঘেদের খেলা দেখতে দেখতে মিষ্টি একটা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতাম। কথার ফাঁকে আমি দুজনের জন্য কফি করে নিয়ে আসতাম। কফি খেয়েই সে গীটারে গান ধরতো। আর আমি নির্বাক শ্রোতার মতো মন্ত্রমুগ্ধ শুনতাম। আহা! কি সুন্দর সেই গান! কি মধুর সেই কন্ঠ।
.
নতুন বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে, যখন ভীষণ জ্বর আসতো। সে দিন-রাত পাশে থেকে আমার দেখাশুনা করতো! নিজেই আমার পছন্দের চিকেন স্যুপ তৈরী করতো। নিজের হাতেই আদর করে খাইয়ে দিত। সময়মতো ঔষধ খাইয়ে দিত। কখনো আমার আগুনগরম মাথায় পানি ঢালতো, কখনো কপালে পানির পট্টি দিত। সারাটা রাত আমার পাশে বসেই কাটিয়ে দিতো, একফোঁটাও ঘুমাতো না। কিছুক্ষণ পরপরি কপালে হাত রেখে বলতো “নিঝুম, জ্বরটা কি একটু কমেছে? তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?” কথাটা সে এমনভাবে বলতো যেন জ্বর আসার কারণে আমার চাইতে ওর বেশি কষ্ট হচ্ছে।
.
যেদিন আমাদের প্রথম সন্তান হলো, হাসান যে কি খুশি হয়েছিল! ওর খুশি দেখে মনে হয়েছিল, পুরো পৃথিবীটাই যেন কেউ তার নামে লিখে দিয়েছে। পুরো এলাকার মানুষকে সে, মিষ্টি খাইয়েছিল সেদিন! হাসানের মতো তার মা-বাবাও ভালো মনের মানুষ ছিলেন। আমার নিজের মা-বাবা ছিলেন না। ছোটবেলা থেকেই একটা এতিমখানায় বড় হয়েছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের মা-বাবার মতোই দেখাশুনা করতাম। কয়েকদিনেই  দুজনের মন জয় করে ফেলেছিলাম। তাদের পছন্দের খাবার রান্না করতাম। নিয়মিত বাবার হার্টের ঔষধ খাইয়ে দিতাম। মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়ে হাঁটতে বের করতাম। মায়ের চুল আঁচড়ে তেল দিয়ে দিতাম। তাঁদের ঘর গুছিয়ে দিতাম, কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতাম। অবসরে একসাথে গল্প করতাম। আহা! সেই সব দিন কতই না সুন্দর ছিল।
.


কিন্তু, প্রকৃতির নিয়ম মতে একতরফা সুখ কারো ভাগ্যেই জোটে না। আমারো এর ব্যতিক্রম হলো না। একদিন মধ্যরাতে হাসানের বুকে ব্যাথা শুরু হলো, এত্তো ব্যাথা যে, সে ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হাসানকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন। কথাটা আমি এক মূহুর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমার হাসান বেঁচে আছে, তার কিছু হয়নি। ডাক্তাররা আমায় মিথ্যা বলছেন। মা-বাবা বাকি সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমি নিজেও খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? আমরা কেউ কাউকে  সান্ত্বনা দেবার অবস্থায় ছিলাম না তখন।
.
তারপর শুরু হলো আমার জিবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। যেখানে ছিল শুধু অপমান, লাঞ্চণা, বঞ্চণা। হাসান মারা যাওয়ার পর সংসারে নেমে এলো ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ। আমার দেবর রনির উপর পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়লো। অবশ্য তার মাসিক আয় আমাদের পুরো সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ঠ ছিল। প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাক চললেও কিছুদিন পর রনির স্বভাবে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সে নানা ভাবে এটা বুঝাতে চেষ্টা করতো, আমি আর আমার মেয়ে এই সংসারের জন্য বোঝা। আমরা শুধু শুধু সংসারের অন্ন ধ্বংস করছি। মাঝে মাঝে এমন ও বলতো যে, সে তার সমস্ত টাকা সংসারে ব্যয় করে ফেলছে, তার ভবিষ্যতের জন্য কোনো টাকা জমাতে পারছে না। আমরা তার ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছি। এসব শুনে খুব কাঁদতাম, কিন্তু কাউকে কিছুই বলতে পারতাম না। নির্লজ্জের মতো সংসারটাকে কামড়ে ধরে পড়ে ছিলাম হাসানের স্মৃতি জড়ানো ঘর আর শ্বশুর-শাশুড়ির টানে। আমি বুঝতে পারতাম আমি চলে গেলে হাসানের মা-বাবাকে দেখার মতো কেউ ই থাকবে না। তারা বড্ড অসহায় হয়ে পড়বে। যদিও আমার প্রতি রনির এসব অমানবিক ব্যবহার দেখে উনাদের ও খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু উনাদের কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। কারণ তারা নিজেরাও আমার মতো রনির উপার্জনের উপরে বেঁচে ছিলেন। অবস্থা বেশি খারাপ দেখে একদিন মা কাঁদতে কাঁদতে বলেই ফেললেন, আমি যাতে একটা বিয়ে করে অন্য ঘরে চলে যাই। প্রথমে আমি রাজি হয়নি; শুধু মাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম:- “মা! আমি চলে গেলে সকালে আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে হাঁটতে বেরুনোর কথা কে বলবে? বাবার নিয়মিত ঔষধ খাওয়ার কথা কে মনে করিয়ে দেবে? কে ই বা আপনার মাথায় তেল দিতে দিতে সুখ-দুঃখের গল্প করবে? কথাগুলো শুনে মা কিছুই বলেন নি। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন শুধু।
.
তারপরেও আমার বিয়ের জন্য অনেক জায়গা থেকে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। বরপক্ষের সবাই আমায় পছন্দ করলেও, আমার মেয়েকে কেউ পছন্দ করে নি! শুধুমাত্র আমার সন্তান আছে এই কারণে সবগুলো সম্বন্ধই ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারতাম না একটা নিষ্পাপ বাচ্চা থাকাটাকে তারা কেন খারাপ ভাবে দেখছিল। শেষমেষ মা-বাবা রনিকে বলেছিলেন, যাতে সে আমায় বিয়েটা করে, কিন্তু রনি রাজি হয় নি। কোনো উপায় না পেয়ে আমিও একবার নির্লজ্জের মতো রনিকে বলেছিলাম আমায় বিয়ে করার কথা। কারণ আমি চেয়েছিলাম হাসানের মা-বাবার পাশে, এই সংসারে হাসানের সাথে কাটানো স্মৃতির চিহ্নগুলোর সাথে চিরকাল থাকি। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না।
.
কিছুদিন পর রনি একটা মেয়েকে বিয়ে করলো। রনির বউয়ের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে। সে মা-বাবাকে এবং বিশেষ করে আমায় তার স্বামীর উপার্জিত অর্থ নষ্ট করছি বলে প্রায়ই খোটা দিত। রনিও তার বউয়ের পক্ষেই ছিল। একদিন তো রনি বলেই ফেলল যে, আমি এই সংসার ছেড়ে চলে গেলে নাকি তাদের জন্য ভালো হয়। বুঝতে পারলাম, এই সংসার আমায় ত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু যাবো কোথায়? আমার তো মা-বাবা কেউ নেই। শেষে এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে উঠলাম। এত্তো বছর থাকা সংসারটা ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছিল। চলে যাওয়ার দিন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি খুব কেঁদেছিলেন। আমি ও কেঁদেছিলাম। অবশ্য কান্না ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করারও ছিল না। ভেবেছিলাম বান্ধবীর বাসায় থাকতে থাকতে একটা কাজ জোগাড় করবো! কিন্তু অনেকদিন খুঁজেও কোনো কাজ পেলাম না। দুটো চাকরির ইন্টারভিউতে টিকে ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোটা অঙ্কের ঘুষের জন্য চাকরি হয়নি। এদিকে বান্ধবীর বাসায় উঠেছি প্রায় দুইমাস হতে চলছিল। বান্ধবী কিছু না বললেও তার স্বামী প্রায়ই আমার থাকা নিয়ে তারসাথে কথা কাটাকাটি করতো। বুঝতে পারলাম বান্ধবীর বাসাও আমায় ছাড়তে হবে।আমার জন্য তাদের সংসারে ঝগড়া লাগা কোনো কাজের কথা না। কিন্তু কোথায় যাবো? কি খাবো? কি করবো? একটা প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা ছিল না। আমার চোখেমুখে যেন কালবৈশাখির অন্ধকার দেখতে লাগলাম। পরে সর্বশেষ আর কোনো উপায় না পেয়ে এই পতিতার পথে আসা।
– কথাটা বলেই নিঝুম কাঁদতে শুরু করলো!
.
ইসতিয়াক সাহেব এত্তোক্ষণ মেয়েটার পুরো জীবন কাহিনী শুনলেন। পতিতার পথে নিঝুমের আজ প্রথম দিন। পতিতা শব্দটা এখনো তার শরির ও মনের সাথে মেশে নি। কিন্তু মিশতে কতক্ষণ? একটু পরই হয়তো কোনো না কোনো পুরুষের ভোগের মাধ্যমে তার শরিরে এবং মনে পতিতা শব্দটির স্থান পাবে। ইসতিয়াক সাহেব বুঝতে পারছেন, কতটুকু কষ্টের মধ্য দিয়ে গেলে একটা মেয়ে পতিতার পথে নেমে আসে। ওনি কোটিপতি মানুষ। প্রতি সপ্তাহে একটা মেয়েকে ভোগ করা ওনার রুটিনের মধ্যে পড়ে! কোনোরকম সন্দেহ ছাড়া ওনাকে খারাপ মানুষ বলা যায়। কিন্তু কেন জানি আজ, একজন পতিতার জীবনকাহিনী শুনার পর ওনার চোখ ভিজে গেল। ওনি খুব কাঁদছেন; কিন্তু কেন কাঁদছেন বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ ইসতিয়াক সাহেব বললেন:- শোনো মেয়ে, আমার অফিসে একটা কর্মচারীর পদ খালি আছে। ঐ পদে কাজ করলে মাসে বিশ হাজার টাকার মতো পাবে। আশা করি এতে তোমাদের মা-মেয়ের হয়ে যাবে।

কথাটা যেন নিঝুম বিশ্বাস করতে পারলো না। হঠাৎ তার কেন জানি মনে হলো ইসতিয়াক সাহেব পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষগুলোর একজন! নিঝুমের মুখে অনেকদিন পর হাসি ফুটছে। কত পবিত্র সেই হাসি। পতিতা না হবার হাসি। মেয়েকে নিয়ে একটু সুখে বেঁচে থাকার হাসি।

ইসতিয়াক সাহেব নিঝুমের হাসির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। এত্তো পবিত্র হাসি কি তিনি আগে কখনো দেখেছেন? হঠাৎ ওনার মনে হলো, এই হাসিটা তার মায়ের! তিনি যখন রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরতেন, তখন ওনার মা ওনাকে দেখে ঠিক এরকম করে হাসতেন। এই পবিত্র হাসিটা প্রতিদিন দেখতে পেলে মন্দ হয় না! তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন, আজ থেকে প্রতিদিন একটা করে পতিতাকে এই কলুষময় কাজ থেকে মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে আসবেন। সারাজিবন তো অনেক খারাপ কাজ করা হলো; বাকি জীবনটায় একটু পবিত্র কাজ করলে ক্ষতি কি?

Share This Article